শিক্ষা ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ১০:০৭

স্লোভেনিয়ায় উচ্চশিক্ষা শেষে অভিবাসনের সুযোগ

ছবিঃ প্রথম আলোর

ছবিঃ প্রথম আলোর

ডেস্ক রিপোর্ট

মধ্য ইউরোপে ছোট একটি দেশ স্লোভেনিয়া। আয়তনের মত দেশটির জনসংখ্যাও খুব বেশি নয়। ২১ লাখের কাছাকাছি জনসংখ্যার মধ্য ইউরোপের দেশটির উত্তরে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ইতালি, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূল দ্বারা বেষ্টিত।

ইউরোপের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল যথা: আল্পস পর্বতমালা, প্যানোনিয়ান প্লেট, ভূমধ্যসাগর এবং ডিনারেইডসের মিলন ঘটেছে এ স্লোভেনিয়ায় এসে।

লুবলিয়ানা দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। স্লোভেনিয়া একসময় লিবারেল কমিউনিজমের ভিত্তি ভূমি হিসেবে পরিচিত সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অংশ। ১৯৯১ সালের ২৫ জুন প্রথম কোনো রাষ্ট্র হিসেবে স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভিয়ার জোট থেকে বেরিয়ে নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়া সে সময় স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার দাবিকে অস্বীকার করে। শুরু হয় যুদ্ধ, যা ১০ দিন ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিলও। এ জন্য ইতিহাসে স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধকে ১০ দিনের যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল ইউরোপ মহাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সংগঠিত যুদ্ধ, যেখানে ৭৬ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। তাই স্লোভেনিয়াকে অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিলেও ভুল হবে না। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে। ২০০৪ সালে স্লোভেনিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ পায়। ২০০৭ সালে টোলারের বদলে ইউরো দেশটির জাতীয় মুদ্রা হয়। একসময় কমিউনিজম শাসনের প্রচলন ছিল, এমন রাষ্ট্রের মধ্যে স্লোভেনিয়াই সর্বপ্রথম ইউরোর ব্যবহার শুরু করে। ব্রাউন বিয়ার, বিভিন্ন ধরনের সুউচ্চ পর্বতমালা বিশেষ করে আল্পস পর্বতমালা ও বিভিন্ন হৃদ ও স্কি রিসোর্টের জন্য স্লোভেনিয়া পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল।

  • দেশটির সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

শিক্ষাক্ষেত্রে দেশটির অগগ্রতি চোখে পড়ার মতো। স্লোভিন দেশটির মানুষের প্রধান ভাষা হলেও সর্বত্র প্রায় সবাই ইংরেজি বলতে পারেন। ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা, ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, ইউনিভার্সিটি অব প্রিমরস্কা দেশটির উল্লেখযোগ্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা এবং ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর আন্তর্জাতিক যেকোনো সূচকে সারা পৃথিবীর প্রথম পাঁচ শটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে স্থান পেয়েছে।

আমাদের দেশ থেকে যখন কেউ বাইরের কোনো দেশে আসার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, প্রথমে তাঁর মাথায় যে জিনিসটি কাজ করে, সেটি হচ্ছে ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার এবং এ ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া অনেকটাই নমনীয়। কেননা স্লোভেনিয়ার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডিগ্রি প্রোগ্রাম পাওয়া যায় ইংরেজিতে এবং এখনো ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় স্লোভেনিয়ায় অনেক কম খরচে পড়াশোনা করা যায়। স্লোভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর কিংবা মাস্টার্সসহ যেকোনো লেভেলে পড়াশোনা করতে হলে এক বছরে ২ হাজার ৮০০ ইউরো থেকে ৪ হাজার ইউরোর মতো টিউশন ফির প্রয়োজন এবং দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয়ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক কম। কিছু ইউনিভার্সিটিতে কিছু নির্দিষ্ট সাবজেক্টের ক্ষেত্রে এক বছরে ৮ হাজার ইউরো টিউশন ফির প্রয়োজন হতে পারে।

  • পার্ট টাইম চাকরির সুযোগ

আবার আমাদের দেশ থেকে যাঁরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে আসতে চান অনেকের মাঝেই পার্টটাইম চাকরির চিন্তাভাবনা কাজ করে এবং এ ক্ষেত্রেও স্লোভেনিয়া অনেকটা নমনীয়। ‘এম জব সার্ভিস’ এবং ‘ই-স্টুডেন্টস্কি সার্ভিস’ নামে দুটি অর্গানাইজেশন রয়েছে, যাঁরা শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম চাকরির ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করে থাকে। দুটি অর্গানাইজেশন স্লোভেনিয়ার প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আরও রয়েছে ‘বনি বা সাবসিডাইজড মিল’ এবং ‘সাবসিডাইজসড বাস সার্ভিস’ নামে দুটি বিশেষ পরিষেবা যেখানে আপনি একজন স্টুডেন্ট হিসেবে অনেকটা সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার কিংবা গণপরিবহন ব্যবহারের সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।

  • অ্যাপ্লিকেশন ফি নেওয়া হয় না

স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতে হলে আপনাকে এই লিঙ্কে (https://portal.evs.gov.si/prijava/?locale=en) গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে অ্যাপ্লিকেশন শুরু করতে হবে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি থেকে অ্যাডমিশনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করা শুরু হয়ে জুন পর্যন্ত অ্যাপ্লিকেশনের সময়সীমা থাকে। সাধারণত প্রতিবছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সেশনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করা হয়; তবে কদাচিৎ কিছু ইউনিভার্সিটিতে কিছু নির্দিষ্ট সাবজেক্টের জন্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ সেশনের জন্যও অ্যাপ্লিকেশন নেওয়া হয়। প্রতিবছরের অক্টোবর মাস থেকে স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটিতে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। অ্যাকাউন্ট চালু হয়ে যাওয়ার পর আপনাকে ‘Academic Year’ এবং আপনার পছন্দের ইউনিভার্সিটি ও পছন্দের সাবজেক্ট সিলেক্ট করে একটা অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ফরম পূরণ করতে হবে। সেখানে আপনার পার্সোনাল ডিটেইলস চাওয়া হবে। স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলোতে অ্যাপ্লিকেশন করার ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো ধরনের অ্যাপ্লিকেশন ফি নেওয়া হয় না।

  • আবেদনের পদ্ধতি

অনলাইনে ফরম পূরণ করা হয়ে গেলে আবেদনকারী শিক্ষার্থীর কাছে একটি ই-মেইল পাঠানো হয় এবং এ ই-মেইলে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে একটি পিডিএফ ফাইল দেখতে পাওয়া যায়। এ পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করতে হবে এবং পরে সেটাকে প্রিন্ট আউট করে আবেদনকারী শিক্ষার্থীর একটি স্বাক্ষর প্রদান করতে হয়। অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ফরম পূরণ করার কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাপ্লিকেশন পূরণ করার সময় যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছিল, সে ঠিকানায় ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডমিশন অফিসের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাঠানো হবে। এরপর সে চিঠিতে উল্লেখিত ঠিকানায় প্রিন্ট আউট করা উক্ত পিডিএফ ফাইলের কপি যেটিতে একটু আগে সিগনেচার করার কথা বলেছিলাম, সেটি কুরিয়ার সহযোগে ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডমিশন অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে আরও যেসব ডকুমেন্ট সংযুক্ত করতে হবে:

i) যাবতীয় সব একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্টের অরিজিনাল কপি;
ii) যাবতীয় সব একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্টের এক সেট সত্যায়িত কপি;
iii) যেকোনো ইংলিশ প্রফিসিয়েন্সি সার্টিফিকেটের কপি;
এ ছাড়া মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য যদি কেউ আবেদন করে থাকেন, তাঁর ক্ষেত্রে অনেক সময় সিভি, মোটিভেশনাল লেটার এমনকি ব্যাচেলরের কোর্স ডেসক্রিপশনও চাওয়া হতে পারে।

বাংলাদেশের সার্টিফিকেট কিংবা মার্কশিটের কিংবা অন্য কোনো ধরনের ডকুমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে লিগালাইজেশন করতে বলা হয়। স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে বাংলাদেশি কোনো ডকুমেন্ট লিগালাইজেশন করার শর্ত হচ্ছে প্রথমে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অবস্থিত বাংলাদেশের এম্বাসি থেকে সেগুলোকে অ্যাটাস্টেশন করা।

স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি আপনার ডকুমেন্ট ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার যাবতীয় একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্টের কপি স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে লিগালাইজেশন করানো হয়। আর স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স বাংলাদেশের কোনো ডকুমেন্ট ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আপনার ডকুমেন্ট অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করাতে পারছেন এবং তাদের ওয়েবসাইটে এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে।

একমাত্র ভিয়েনায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কোনো ডকুমেন্ট অ্যাটাস্টেড করা হলেই কেবল স্লোভেনিয়ার ফরেন মিনিস্ট্রি আপনার ডকুমেন্ট লিগালাইজেশনের জন্য গ্রহণ করবে। স্লোভেনিয়ার ফরেন মিনিস্ট্রি কোনো ডকুমেন্ট লিগালাইজেশনের জন্য পৃষ্ঠা প্রতি তিন ইউরো করে রাখে এবং দুর্ভাগ্যবশত তারা কোনো কুরিয়ার কপি গ্রহণ করে না। অনেক সময় ইউনিভার্সিটিকে অনুরোধ করলে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ লিগালাইজেশনের ব্যবস্থা করে দেয়। ভিয়েনায় বাংলাদেশ এম্বাসি থেকে কোনো ডকুমেন্ট অ্যাটাস্টেশন করার শর্ত হচ্ছে, প্রথমে সেটিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা সত্যায়িত হতে হবে এবং ভিয়েনার বাংলাদেশ এম্বাসি যেকোনো ডকুমেন্ট অ্যাটাস্টেশন করতে পৃষ্ঠাপ্রতি ১০ ইউরো করে রাখে।

সাধারণত স্লোভেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময় দেয় যাবতীয় ডকুমেন্ট পাঠানোর জন্য। তবে এ সময়ের মধ্যে পাঠাতে না পারলে আপনি অতিরিক্ত সময়সীমার জন্য আবেদন করতে পারেন এবং আপনাকে এর জন্য নির্ধারিত তারিখের আগে ইউনিভার্সিটিকে ই-মেইল দিতে হবে।

অ্যাডমিশন নিশ্চিত হয়ে গেলে আপনি ইউনিভার্সিটি থেকে লেটার অব অ্যাকসেপ্টেন্স পাবেন। আপনাকে কুরিয়ারের মাধ্যমে লেটার অব অ্যাকসেপ্টেন্স পাঠানো হবে। যদি লেটার অব অ্যাকসেপ্টেন্সে এ সময় টিউশন ফি প্রদানের কথা উল্লেখ থাকে, তাহলে যেকোনো ব্যাংকে গিয়ে স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করে টিউশন ফি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি টিউশন ফি গ্রহণের পর আপনাকে চূড়ান্ত ‘লেটার অব ইনরোলমেন্ট’ পাঠাবে।

ইউনিভার্সিটিতে ইনরোলমেন্ট নিশ্চিত হয়ে গেলে আপনাকে ভিসা কিংবা টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিটের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে।

 

লেখা-রাকিব হাসান