শিল্প ও সাহিত্য ৩ অক্টোবর, ২০২২ ০৩:২৭

কুমিল্লার এশিয়া লাইন বাস এবং অদ্ভুত মেয়ে

সুকান্ত দাস বলেছিলেন, একবার কেউ পেলে তোমাকে ভুলে যায় স্বাধীনতা। তুমি বরফ যুগের শেষ মানবীর হাসির সজীবতা। ঘটনাটা ঘটেছে ৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। বেলা বারোটা । এশিয়া লাইন বাসটি শাসনগাছা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে কেবল। অন্যদের মতো আমিও দৌঁড়ে গিয়ে কোনোরকম আমার আসন নিশ্চিত করলাম।

বিকেলে টিএসসিতে একটি প্রোগ্রাম থাকায় অগত্যা আমাকে এই ভর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়েছে। আমার ঠিক বামপাশে একসিট সামনে ৪৫° এংগেলে আঁড়াআড়ি বসে আছে এক অপরিচিতা। ওনার চোখের মায়ায় হারিয়ে গিয়েছি নিজের অজান্তেই। পৃথিবীর সব মায়া যেখানে হার মেনেছে, সেখানে আমি নিতান্তই নগণ্য মানুষ।

আমি ওনাতে হারালেও ওনি তখনো দিব্যি এন্ড্রয়েড নিয়ে ব্যস্ত। হোয়াটসঅ্যাপে একের পর এক বান্ধবীকে টেক্সট করে যাচ্ছেন। এন্ড্রয়েড স্ক্রীণ বলছে একবার আপু নামে সেইভ করা কাউকে হয়তো কল ও করেছেন। ওনার বাম পাশে বসে থাকা মধ্যবয়সী এক তরুণকে দেখে প্রথমে সুলোচনার কেউ মনে হলেও টিকেট চেকিংয়ের পরক্ষণেই ভুল ভাঙ্গে আমার।

এশিয়া লাইন বাস এবং তাদের দুজনের ই আলাদা টিকেট। আমার মতো ওনিও বাসে ভাঙতি নিয়ে না ওঠার অপরাধে সুপারভাইজার ওনার টিকেটের গায়ে ২৫০/= টাকা বকেয়া পাওনা লিখে চলে গেছেন যেটা বাসথেকে নামার আগে আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে। সুলোচনা তার নেকাবের ভিতর থেকে সাদা রংয়ের এয়ারবাড খুলে ওনার পার্টসে রেখেছেন। পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর যেখানে ওনার চোখের কাছে হার মানছে, সেখানে আঁড়চোখে আমি দিব্যি তাকিয়ে আছি। মাঝপথে জুম্মার নামাজের বিরতিতে এশিয়ালাইন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিয়ে সার্বিক বিষয়ে বন্ধু শাউনের সাথে ভাঙা গলায় কথা বলছি আমি। ওনিও ব্যাপারটা অনুসন্ধিৎসু চোখে সচেতন পরখ করে যাচ্ছেন রীতিমতো। হৃৎস্পন্দন বাড়ছে আমার। উত্তরের বাতাসের ঝাপটা বাসের জানালা দিয়ে অনর্গল ভিতরে প্রবেশ করলেও দিব্যি ঘামছি আমি। সেইসাথে চলছে অপরিচিতার সাথে আমার সচেতন দৃষ্টিবিনিময়।

উচ্চতা আভিজাত্য আর রুচিশীলতায় ওনি এতোটাই প্রভাবিত করেছেন আমায় যা কোনো কলমের কালিতে লিখে শেষকরা করা সম্ভব নয়। প্রথমে ভেবেছি, বাসেই একটু কথা বলি। পাশেই তো ওনি। কিন্তু সাহস হয়ে উঠেনি। এভাবে বার কয়েক চেষ্টায় আমি ব্যর্থ হয়েছি। বারবার পরাজয়ের পর রবার্ট ব্রুসের রাজ্য বিজয়ের অসমাপ্ত গল্প এখানে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছেনা আমার। তীর্থের কাকের মতো প্রচন্ড পিপাসায় ভিতরটা ছটফট করলেও কোনোভাবেই যেন প্রকাশ করতে পারছিনা। বাস এগুচ্ছে তার আপন গন্তব্যে আর আমি যথারীতি ওনার হাতেথাকা শেকলবন্দী পার্টসের মতো নিজেকে ওনার মাঝে বন্দী করে ফেলেছি। কয়েদী কোনোভাবেই যেন চোখ ফেরাতে পারছেনা। সম্ভব নয়। যেখানে রবি ঠাকুর কিংবা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো শিল্পপ্রেমীরা ব্যর্থ হয়ে শিল্পরচনা করে গেছেন, সেখানে আমি নগণ্য শিল্পকারিগর কিভাবে সফল হয়ে উঠবো? কাজলা স্টেশনে নেমে চলে আসার কথা আমার। কিন্তু নামতে পারলাম না। সুলোচনা তখনো ওনার আসনে দিব্যি বসে আছেন।

আঁড়চোখে হয়তো আমাকে দেখছেন। ভাবছি, আমিও এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। সেইসাথে মনস্হীর করলাম বাস থেকে নামার পর ওনাকে ডেকে কথা বলবো। কিন্তু হয়ে উঠছেনা। এশিয়া লাইন বাস তার শেষ গন্তব্যে চলে এসেছে। ওনি নামছেন। আমিও ঠিক ওনার পিছনটায়। সাদা রংয়ের মানুষটার গায়ে কালো হিজাব, চোখে চশমা, হাতে একটা সোনালী রংয়ের ঘড়ি আর সোনালি কভারের জুতোয় ওনাকে স্বর্গের অস্পরীর মতো লাগছে। এশিয়া লাইন থেকে বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে ওনি নেমেছেন। পিছনে আমিও। কিন্তু হায়, আমি কথা বলার সাহস করে উঠলেও তা আর বলা হয়ে উঠছেনা। আবু জাফর সামছুদ্দীনের ভাষায়, সংশয়ের ঘড়ির কাঁটাটা দুলতে দুলতে একপাশে হেলে যাচ্ছে আমার। সুলোচনার হাতে একটা ব্যাগ, ছোট্ট কাগজের ব্যাগ আরও একটা। কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে ভাবছি হয়তো ওনি কিছুক্ষণ দাঁড়াবেন।

আমার সচেতন চাহুনিকে অবাক করে দিয়ে তিনি দুবার আই কন্ট্রাক করে রিক্সায় চড়লেন। আমি দিব্যি তাকিয়ে আছি অস্পরীর পথপানে। তখন এইটুকু সেন্স ও কাজ করে নাই যে আমার পিছু নেয়া উচিত। ঠাঁই দাড়িয়ে আছি পাথরের মতো। নেভিব্লো টিশার্ট আর আমার চশমা, কাঁধে থাকা ব্যাগ আর আমার সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ওনি পথ চলছেন একা! কোনো হিতাহিত জ্ঞান কাজ করছেনা আমার। ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সায়দাবাদের ধূলির সমুদ্রে স্নান করিয়ে বাসায় ফিরছি আর ভাবছি, এটা গল্প হলেও পারতো। যেহেতু এটা গল্প ছিলোনা, আমি আমার সুচিস্মিতার সন্ধান চাই।

এই শহরের জরাজীর্ণ সায়দাবাদের অলিতে গলিতে আমি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিবো শতবার। আমার সুলোচনাকে আমি চেয়েছি মুহুর্তে মুহূর্তে অনিবার। সুকান্ত দাস ঠিকই বলেছিলেন, "একবার কেউ পেলে তোমাকে ভুলে যায় স্বাধীনতা, তুমি বরফ যুগের শেষ মানবীর হাসির সজীবতা। তুমি যদি তাকাও হার মেনে নেয় সহস্র কৌরব, এই পৃথিবীর সব রমণীতে খুঁজি তোমার অবয়ব।" উক্ত বর্ণনার সাথে যদি কারোর সাদৃশ্য পেয়ে থাকেন, দয়াকরে ওনার পর্যন্ত তথ্যগুলো পৌঁছে দিবেন। নয়তো নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে এ শহর।

 

inresponse606@gmail.com

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়