অর্থ ও বাণিজ্য ১১ অক্টোবর, ২০২২ ১২:৫৯

রাষ্ট্রের আয় নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

করোনা শুরুর পর থেকে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় আয় কমেছে দেশের সাধারন মানুষের। এতে ব্যয়ের চাপে দিশেহারা সাধারণ নাগরিক। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারের সবখানেই রয়েছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব। সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় নিত্যদিনের ব্যয় সামলাতে মানুষ জমানো সঞ্চয় ভেঙে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। 

এমনকি দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতের আয়ও একসঙ্গে কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমায় রাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার বিষয় হলো রিজার্ভ। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগে থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছে। গত বছর আগস্টেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি ছিল। সর্বশেষ হিসাবে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ডলার। ইতোমধ্যে রিজার্ভ ১ হাজার ১৫৬ কোটি ডলার কমে গেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় এভাবে কমতে থাকলে  রিজার্ভ আরও কমে যাবে। এতে অর্থনীতির চাপ আরও প্রকট হবে। এসব পরিস্থিতি বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বেশ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, সরকারি হিসাবে দেশের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

প্রতিটি পণ্যর মূল্য বৃদ্ধির কারণে খরচের সঙ্গে পেরে না ওঠায় অনেক মানুষ সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে জমানো আমানত ভাঙতে শুরু করেছে। ফলে টাকা চলে যাচ্ছে ব্যাংকের বাইরে। কেউ আবার মেয়াদপূর্তিতেও পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অব্যাহতভাবে আমানত কমলে ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ভোক্তাদের ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের মিল নেই বলেই সঞ্চয় ভাঙছে। সঞ্চয় কমে যাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। গ্রাহকরা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সঞ্চয় ভাঙলে সেটা আরও খারাপ। 

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে এমনটি হয়েছে। এখন যে করেই হোক দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। তখন ভোক্তার ব্যয় কমবে। সঞ্চয় বাড়তে শুরু করবে।

পণ্যর মূল্য বৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। গম, ভুট্টার মতো খাদ্যপণ্যের দামসহ বেড়েছে বিভিন্ন কাঁচামালের দামও। কোনো কোনো পণ্যের দাম একলাফে কয়েকগুণ বেড়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরপরই জীবনযাত্রার খরচ বাড়তে শুরু করে।
মানুষের সঞ্চয়ের একটি বড় খাত হলো সরকারি সঞ্চয়পত্র। এটি সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণে ঋণ নেওয়ার বড় খাত হলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে সরকার। গত আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৮ কোটি টাকার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। আগের বছরে আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪০১ কোটি টাকার। গত অর্থবছরে এই দুই মাসে আয় হয় ৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। 

অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের আয় গত বছরের তুলনায় ১৪ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এটি মানুষের সঞ্চয় কমে যাওয়ার একটি চিত্র।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, সাধারণত সঞ্চয় করেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির গড় হিসাব সরকারিভাবে যা প্রকাশ করা হচ্ছে, তার চেয়ে নিত্যপণ্য কেনার খরচ বাস্তবে অনেক বেশি। 

তিনি আরও বলেন, বাজার অর্থনীতিতে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ যারা সঞ্চয়কারী, তারা যে শুধু সঞ্চয় দেশে রাখবে তা নয়, তারা বিদেশেও সঞ্চয় করতে পারে। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। নইলে টাকা পাচার হয়ে যাবে। 

এদিকে মানুষের ব্যয়ের এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছে রাষ্ট্রও। বৈদেশিক খাতের আয় একসঙ্গে কমেছে। রেমিট্যান্স কমেছে ২৪ শতাংশ আর রপ্তানি আয় কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। এতে কমতির ধারায় থাকায় রিজার্ভ আরও বেশি চাপে পড়ছে। 
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে প্রবাসীরা কম পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাতে পারছেন। একই কারণে কমেছে পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ (অর্ডার)। 

এদিকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দুই ধরনের দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের উৎসগুলোর তিনটি খাত হচ্ছে রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, যা দেশের সক্ষমতা বাড়ায়। শ্রীলংকার সংকটে পড়ার কারণ, দেশটির কাছে পণ্য আমদানি করার মতো এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রা নেই। পাকিস্তানও একই কারণে বিপাকে রয়েছে।

এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, করোনা মহামারির পরে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পণ্য রপ্তানি খাত। টানা ১৩ মাস ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলত তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় সাড়ে ৭ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে গত মাসে সার্বিক পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাক ছাড়া হোম টেক্সটাইল ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।

রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তিন মাস ধরে পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশ আসার গতি কম। কয়েকটি বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। আবার যতটুকু ক্রয়াদেশ আছে, তার সবটুকুও গ্যাস ও বিদ্যুৎসংকটের কারণে রপ্তানি করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ডলার, যা গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর চেয়ে কম রেমিট্যান্স আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ডলার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে ১৭২ কোটি ডলার।