আন্তর্জাতিক ১ নভেম্বর, ২০২২ ১১:২৪

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দিরা গান্ধী এমন একটি নাম, যে নাম শুনলে নেতৃত্বের কথা মনে পড়ে যায় মানুষের। যিনি গোটা ভারতবর্ষের পরিচিত মুখ। শুধু তাই নয়, বিশ্বের প্রতিটি রাজনীতিবিদদের কাছেও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

ইন্দিরা গান্ধী হলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী যিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছিলেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি উদ্বাস্তুকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলাদেশের সমর্থন চেয়েছেন। এক পর্যায়ে তিনি সরাসরি নিজ দেশকে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৮৪ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই প্রকৃত বন্ধু তার দুই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন।

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের তৃতীয় এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বিদ্যমান বহু ধর্মীয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক উপদল থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। 1964 সালে তার মৃত্যুর দুই বছর পর, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। ইন্দিরাকেও তার বাবার মতো একই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। যদিও বিরোধীরা ইন্দিরা গান্ধীকে স্বৈরাচারী বলে সমালোচনা করেছিল, তিনি তার ব্যাপক সামাজিক কর্মসূচির কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ১৯৭৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাকে চার বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ সহ কিছু অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তার সংসদীয় সদস্যপদ বাতিল করার পাশাপাশি তাকে ছয় বছরের জন্য সরকারি পদ থেকে নিষিদ্ধ করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা জরুরি অবস্থা জারির সুপারিশ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করেন, যা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এরপর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

১৯৭৭ সালের নির্বাচনের পর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখপ্রধান অকালি দলের নেতৃত্বাধীন একটি জোট ক্ষমতায় আসে। এই দলে ভাঙন ধরাতে এবং শিখদের মধ্য থেকে জনসমর্থন আদায় করতে ইন্দিরা গান্ধী রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালাকে দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে ভিন্দ্রানওয়ালা নিজেই অকালি দলে যোগ দেন। ভিন্দ্রানওয়ালার নেতৃত্বে এই দলের একটি অংশ শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানায় এবং তাঁরা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৮২ সালে ভিন্দ্রানওয়ালা ২০০ জন সশস্ত্র বিদ্রোহীকে নিয়ে স্বর্ণমন্দির চত্বরের একটি অতিথিশালায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। ১৯৮৩ সালের মধ্যে স্বর্ণমন্দির চত্বর শিখ বিদ্রোহীদের দুর্গে পরিণত হয়। তাঁরা মন্দিরে লাইট মেশিনগান ও সেমি অটোমেটিক রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র জড়ো করতে থাকেন।

বেশ কয়েকবার আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভিন্দ্রানওয়ালা ও তাঁর অনুগতদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্বর্ণমন্দির চত্বরে অভিযান চালায়। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। পুরো দিন ও রাত ধরে চলা অভিযানে প্রায় চার শ শিখ বিদ্রোহী ও কয়েক জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। মন্দিরের ভেতর থেকে জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে সব শিখ নিরাপত্তাকর্মীকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সুপারিশটি ইন্দিরা গান্ধীর টেবিলে পৌঁছালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে যখন ইন্দিরা গান্ধী তার বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তার দুই শিখ দেহরক্ষী, বায়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং ইন্দিরা গান্ধীকে মোট ২৮টি গুলি করে। অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই দেহরক্ষী খুব দ্রুত এই কাজটি করে ফেলেন। গুলি করার পর বিয়ন্ত সিং আর সতবন্ত সিং নিজেদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেন এবং বলেন, ‘আমাদের যা করার ছিল সেটা করেছি, এবার তোমাদের যা করার করো।’ ইন্দিরা গান্ধীকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা আড়াইটার দিকে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি প্রচারমাধ্যম সন্ধ্যা ছয়টায় তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার করে।


আমাদেরকাগজ/এইচএম