আন্তর্জাতিক ২১ নভেম্বর, ২০২২ ০৬:৩৯

বিশ্বকাপে রাজনীতি

আর্জেন্টাইন জান্তার নৃশংসতা, কলঙ্কিত হয়েছিল ফুটবল

স্পোর্টস ডেস্ক:

(প্রথম পর্ব- ১৯৩৪: মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শক্তি প্রদর্শন)

১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপের মতো ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত টুর্নামেন্টও ছিল রাজনৈতিক বিতর্কে ঘেরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পুরো টুর্নামেন্টকে ‘১৯৩৪ সালের কপি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কাতার ও রাশিয়ার মতো ওই সময় সরাসরি বর্জনের আহ্বানও ছিল। পোস্টার ছাপানো  এবং প্রচার কর্মসূচি হয়েছিল।


এটি দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ যদি মূল ক্রীড়া ধোলাই আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে ১৯৭৮ সালের টুর্নামেন্ট ছিল ফিফার ‘মূল পাপ’, যা নতুন একটি তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে ফিফা কীভাবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেশের সঙ্গেও কাজ করতে রাজি ছিল।

টুর্নামেন্টের আগে ফিফার নিজের স্বৈরাচারী নেতা হোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ যা বলেছিলেন এখনকার সময়েও সেগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত আর্জেন্টিনা একটি দারুণ বিশ্বকাপ আয়োজন করবে… আর্থিকভাবে এবং নিখুঁত বিশ্বকাপ আয়োজনে দেশটির উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে।

পরে হ্যাভেলাঞ্জ আরেকটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বলেছেন, কীভাবে ভিদেলার সামরিক জান্তা একটি টুর্নামেন্ট পরিচালনা করেছে যেখানে ‘শৃঙ্খলা ছিল চরম’।

২০২২ সালের বিশ্বকাপ ঘিরে অন্যান্য কিছু বিষয়ও রয়েছে। রোজারিওতে বস্তি আড়াল করতে বিশাল দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। ভেঙে ফেলা হয়েছিল অনেকগুলো ভবন, শহর থেকে সরিয়ে নেওয়া অনেক বাসিন্দাদের।

জনসংযোগ কর্মসূচিতে ভিদেরা নিয়োগ দেন বুরসন-মার্সটেলার প্রতিষ্ঠানকে। যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেছে রোমানিয়ার কমিউনিস্ট স্বৈরাচার নিকোলাই সিউসেস্কু এবং মার্কিন বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ব্ল্যাকওয়াটারের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে একটি কথা চাউর ছিল ওই সময়, ‘শয়তানের যখন জনসংযোগের প্রয়োজন হয়, তখন শয়তানের স্পিড ডায়ালে থাকে বুরসন-মার্সটেলারের নম্বর’।

উদ্বোধনী খেলায় সামরিকীকরণ কিছুটা শিথিল করেন ভিদেলা। সাধারণ স্যুট পরে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের পাশে দাঁড়ান। জল্পনা রয়েছে, ওই সময় স্টেডিয়ামে আরেকজন উপস্থিত ছিলেন, তিনি হলেন কুখ্যাত নাৎসি যুদ্ধাপরাধী জোসেফ মেঙ্গেলি। যদিও ভিদেলা কথা বলেছেন ‘শান্তির বিশ্বকাপ’ নিয়ে।

শাসকদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকা আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম বিদেশি সমালোচনাকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

আর্জেন্টিনার সাংবাদিক এজেকুইয়েল ফার্নান্দেজ মুরেস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, আর্জেন্টিনার জান্তাকে ডাচ সরকারকে এবিএন ব্যাংকের মাধ্যমে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে এবং অস্ত্র বিক্রি করেছে। অবশ্য টুর্নামেন্ট বয়কট করার কারণে মার্সিডিজ ও সিমেন্সের মতো জার্মান কোম্পানি বিপুল মুনাফা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উভয় দেশেই বিশ্বকাপ বর্জনের ডাক ছিল শক্তিশালী। এক পর্যায়ে ডাচ মিডফিল্ডার উইম ভ্যান হানেগাম এক মানবাধিকার কর্মীকে বলেছিলেন তাকে আহ্বান জানানো বন্ধ করতে।

তবে মায়ের ও রোসি’র মতো কয়েকজন ফুটবলার অবস্থান নেন। এর বাইরে নেদারল্যান্ডস টিমের সাধারণ মনোভাব স্পার্লিংয়ের কাছে তুলে ধরেছেন জনি রেপ। তিনি বলেছেন, আর্জেন্টিনায় কী ঘটছে তা সম্পর্কে অনেক ফুটবলার সচেতন ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ছিল তাদের কাছে বেশি লোভনীয়।

চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জনকারী দেশগুলো যদি অজ্ঞতার ভান না করত তাহলে হয়তো আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের পক্ষে তাদের জানাটুকু অস্বীকার করা কঠিন হতো। এমনকি চার সপ্তাহ ধরে চলা টুর্নামেন্টের সময়েও ২৯জন নিখোঁজ হয়েছিলেন।

ওই টুর্নামেন্টে জয়ী আর্জেন্টিনা দলের ফরওয়ার্ড ওমর লারোসা বলেন, আমরা কিছু জানতাম না। হয়তো কয়েকজন বিষয়টি জানত। আমরা একমাসের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পে ছিলাম। ওই সময় আমরা শুধু দৈনিক পত্রিকা ও কয়েকটি টিভি চ্যানেল দেখতে পেতাম। তাও ছিল একেবারে ন্যূনতম।

বিশ্বকাপের পরে টটেনহামে যোগ দেওয়া রিকি ভিয়া পরে বলেছিলেন, যা ঘটছিল তা যদি জানতেন তাহলে তিনি খেলতেন না।

প্রতি বৃহস্পতিবার নিখোঁজ ব্যক্তিদের মায়েরা প্লাজা ডে মায়োতে মিলিত হতেন। তারা মনে করিয়ে দিতেন দেশের নিখোঁজ সন্তান। কয়েকজন খেলোয়াড়ও শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হতেন সেখানে। তাদের একজন সুইডেনের রাল্ফ এডস্ট্রম। তিনি আরও ঝাপসা চিত্র হাজির করেছেন।

তার কথায়, “যখন আমরা প্রশিক্ষণ সেশনে ছিলাম সেখানে কোনও পর্যটক ছিল না কিন্তু ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি ছিল। সুইডেনে ফেরার পর জেনেছি আমাদের প্রধান কোচ টেলিভিশনে বলেছেন, ‘আমরা কিছু দেখিনি। এটি ছিল সুন্দর দেশ’। আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য ছিল। আমরা অনেক সেনা সদস্য দেখেছি। আমি আর্জেন্টিনার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে, ‘সুইডেনে থাকায় আপনি নিশ্চই সুখী। আমাদের অনেক দুর্যোগ রয়েছে। সুইডেনে যখন ফিরে যাবেন তখন দেশের যত্ন নিয়েন, কারণ আপনাদের একটি মুক্ত দেশ রয়েছে’।”

রক্ষণভাগের খেলোয়াড় আলবার্তো তারানতিনি বিশ্বকাপের আগে বলেছিলেন, তিনি সরাসরি কর্তৃপক্ষের কাছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলেন তার নিখোঁজ দুই বন্ধু সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য।

ওই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে কুখ্যাত ম্যাচ ছিল পেরুর বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার ৬-০ গোলে জয়। যা প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাগতিকদের ফাইনালে জায়গা করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক ছিল ম্যাচটি পাতানো ছিল কি না। কিন্তু টুর্নামেন্টের সূচিতে জান্তার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় ছিল না।

পেরুর কয়েকজন বাসিন্দা পরে দাবি করেছেন, খেলা শুরুর আগে নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে তাদের ড্রেসিং রুমে হাজির হয়েছিলেন ভিদেলা নিজে। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা তোমাদের লাতিন ভাই কারা। আমরা একসঙ্গে বাঁধা, তাই না?’

খেলার সময় চতুর্থ গোল যখন হয় তখন অর্থমন্ত্রী হুয়ান আলেমানের বাড়িতে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। তিনি টুর্নামেন্টের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

এসব কিছু ছাপিয়ে জান্তার বিশ্বকাপ জেতার বেপরোয়া আকাঙ্ক্ষায় আর্জেন্টিনার দল তাদের প্রচারণায় একটি সাধারণ অবস্থান নেয়। লারোসাসহ প্রায় সবার কাছেই তা ছিল ‘জনগণের জন্য’। লারোসা বলেন, ‘আমরা নিজেদের জন্য খেলেছি, সরকারের জন্য নয়, কেউ কখনও সরকারের জন্য খেলে না, যেমনটি খেলেনি ১৯৮৬ সালের দল। আমরা খেলি জার্সি ও পতাকার জন্য।’

বামপন্থী ক্যারিশমাটিক ম্যানেজার লুইস মেনোত্তিও ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে খেলার আগে একই আবেগে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আর্জেন্টিনায় একমাত্র বৈধ হলো ফুটবল’।

জয় উদযাপনের মুহূর্তে অনেক ফুটবলার চেষ্টা করেছেন তাদের যেন ভিদেলার কাছাকাছি দেখা না যায়। যদিও শাসকরা জয়ের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে পুরোপুরি। বিশ্বকাপ জয়কে লাখো প্রফুল্ল জনগণকে আরও পরাধীন করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বকাপ জয়ের পর বুয়েনস এইরেসের অর্ধেক মানুষ উদযাপনের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল।

ফুটবল কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ফেরেইরো ফিফা আনকভার্ড তথ্যচিত্রে বলেছেন, ‘কমিউনিটি হিসেবে এটিই প্রথম আনন্দের মুহূর্ত বলে আমার মনে পড়ে’। দাবি করা হয়, রাজনৈতিক বন্দিরাও উদযাপন করেছেন, নির্মম রক্ষীরাও তাদের পাশে উদযাপনে মেতে ছিলেন। এই বিষয়ে নিচু সারির লিগে খেলা গোল কিপার ক্লডিও তাম্বুরিনি, যিনি ছিলেন দর্শন বিষয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং ভুলবশত রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে তাকে বন্দি করা হয়।

তিনি বলেছেন, ‘ফুটবলের পক্ষেই সম্ভব জাতীয় দলের গোলের পর ভুক্তভোগী ও নিপীড়কদের একসঙ্গে উল্লাস করাতে’।

বেশ কয়েকজন ফুটবলার পরে অনুতাপ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদেরকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশে ফিরে বাস্তবতার মুখে পড়েন রিকি ভিয়া। যখন নিখোঁজ ব্যক্তিদের মায়েরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন বিশ্বকাপে এই বিষয়ে তিনি কথা বলেননি।

গোলরক্ষক উবাল্দো ফিল্লোল বলেন, ‘যখন সময় গড়ায়, গণতন্ত্র ফিরে আসে, আমরা জানতে শুরু করি বাস্তবে কী ঘটেছিল। আমি অনেক বিব্রত কারণ আমি বুঝতে পারি যে, অপহরণ, নির্যাতন ও মানুষকে হত্যায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবকে কাজে লাগানো হচ্ছিলো।’

অবশ্য পৃথক একটি সাক্ষাৎকারে ফিল্লোল একটু ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, অনেক মানুষের কাছে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ হলো ৩০ হাজার মানুষের নিখোঁজ হওয়া। কিন্তু আমাদের দলের কেউ কাউকে নির্যাতন বা হত্যা করেনি। দেশকে একটু আনন্দ দেওয়া চেষ্টা করেছি আমরা এবং সাহসিকতার সঙ্গে আর্জেন্টিনার পতাকাকে রক্ষা করেছি। এজন্য আমি লজ্জিত না।

এছাড়া নেদারল্যান্ডসের সাবেক ফুটবলার আর্নি ব্রান্ডটস আর্জেন্টিনার টেলিভিশনে বলেছিলেন, পূর্ণ বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত থাকলে তিনি টুর্নামেন্ট খেলতে যেতেন না।

ইতালি ও আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপের ভয়াবহতার পর রাশিয়া ও কাতারেও ফুটবল একই ধরনের ভুল করেছে বলে তা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

আমামাদেরকাগজ/ এএইচ