সম্পাদকীয় ৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০৬:৩১

তারা সারা বাংলার 'স্যার' হতে চায়!

জার্মানীয় গোত্র অ্যাংলো স্যাক্সন ও জুটদের ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষার উৎপত্তি। এই গোত্রগুলি ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলে পা রাখে। পরবর্তীতে ১০৬৬ সালে উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অঞ্চলে বসবাসকারী নরম্যান জাতি ইংলিশ চ্যানেল নামক সমুদ্র প্রণালী পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। নরম্যানদের ইংল্যান্ড বিজয়ের পর প্রায় ৩০০ বছর ধরে ইংল্যান্ডের রাজারা ছিলেন নরম্যান বংশোদ্ভূত এবং এসময় রাজকীয় ও প্রশাসনিক কাজকর্ম কেবল নরম্যানদের কথ্য এক ধরনের প্রাচীন ফরাসি ভাষায় সম্পন্ন হত। এই যুগে বিপুল পরিমাণ ফরাসি শব্দ ইংরেজি ভাষায় আত্মীকৃত হয়ে যায়। ইংরেজি 'স্যার' শব্দটিও এরকম একটি শব্দ। যা ফরাসী শব্দ 'স্যায়ার' থেকে এসেছে বারশো শতকের দিকে। ফরাসী দেশে তৎকালীন প্রজারা রাজাদেরকে স্যায়ার বলে সম্বোধন করত। যা পরবর্তীতে ইংরেজিতে স্যার শব্দে রূপান্তরিত হয়।

আমার এই লেখা ইংরেজি ভাষার রূপান্তর নিয়ে নয়। গত ৪ নভেম্বরের একটা সংবাদ দেখে এই লেখার চিন্তা মাথায় আসল। ঢাকার ধামরাই বাজার শাখা কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজারকে 'স্যার' না বলায় এক সেবা গ্রহীতার সাথে দুর্ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ রকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ও সংবাদ মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা উঠে এসেছে। যেমন- গত ১৫ মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বাজার ডাকবাংলোর সামনে লাথি দিয়ে ব্যবসায়ীর মাছের ঝুড়ি ড্রেনে ফেলে দিয়েছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকার। গত ৯ সেপ্টেম্বর যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে স্যার সম্বোধন না করায় ৪ সাংবাদিককে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার সকালে উপজেলা কৃষি অফিসে এই ঘটনা ঘটে। ওই কর্মকর্তার নাম আব্দুস সোবহান।

কিছু ঘটনা নজরে এসেছে কিন্তু সরকারি অফিসে এ ধরনের ঘটনা যে অহরহ ঘটে চলেছে, তার খবর কী আমরা রাখি? ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। একটি সম্বোধন যে আমাদের দেশের সরকারি অফিসে কত বড় করে দেখা হয়, উল্লেখিত ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ। সরকারি দফতরগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বোধন নিয়ে এ দেশের নাগরিকরা অর্থাৎ যাদের করের টাকায় কর্মচারীদের বেতন হয়, সেই কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের শিকার হন প্রতিনিয়ত । তাদের শুধু স্যার-ম্যাডাম না বলার কারণে কত মানুষ যে তার ন্যায্য সেবা পেতে হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন বা সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। ফেঞ্চুগঞ্জের ঘটনার ঠিক সপ্তাহখানেক পর সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কর্মী সালেহীন চৌধুরী সুনামগঞ্জ কালেক্টরেটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ মানুষ বা নাগরিকরা কী বলে ডাকবেন তা জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি।

স্যার বা ম্যাডাম যাই হোক, একজন সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে এই সম্বোধন শুনতে চাওয়া যে আমদানি করা উপনিবেশিক মনোভাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবা করা এবং সেজন্যই তার চাকরি। অথচ ঘটছে উল্টোটা। এটি হওয়ার কথা না। অথচ এটিই হয়ে চলেছে স্বাধীন বাংলায়।

ইংরেজদের হাত ধরে সতেরোশো শতকে এই উপমহাদেশে স্যার শব্দের প্রচলন। ইংরেজরা ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ছিল। তারা এসেছিল আমাদের শোষণ করতে, ভয় দেখাতে। শোষণ করার সুবিধার্থে তারা চাইত এদেশের মানুষের সাথে তাদের একটা দূরত্ব থাকুক। ইংরেজরা এই ভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছে বহু যুগ হয়েছে কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে এখনো রয়ে গিয়েছে সেই ঔপনিবেশিক মানসিকতা। সেসব মানুষের পূর্বপুরুষ যদিও এদেশেরই কৃষক, শ্রমিক কিন্তু তারা তা ভুলে গেছে। যে ইতিহাস পড়ে পরীক্ষা দিয়ে তারা চাকরিতে ঢুকেছে তারা সেই ইতিহাসই ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে যে, দেশটা এখন ব্রিটিশ কলোনি না, পাকিস্তানের অধীনেও না। দেশটা এখন স্বাধীন। দেশটার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই ভুলে যাওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষের সাথে তাদের আচরণ এখনো ব্রিটিশ রাজের কর্মচারীদের মতই। আর সেজন্যই পেশাগত ক্ষেত্রে কনিষ্ঠ কর্মচারীদের 'স্যার' সম্বোধন শুনে তাদের মন ভরে না।

তারা সারা বাংলার 'স্যার' হতে চায়। যেই সাধারণ মানুষের সাথে তাদের এই সামন্তবাদী আচরণ, সেই সাধারণ মানুষই কিন্তু এদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে 'ভাই' বলে সম্বোধন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে বলে 'আপা'। তাদের এই আচরণ দেখে মনে হয়, ইংরেজি SIR শব্দ মানে Slave I remain (sir)। যার অর্থ এখনো দাস হয়েই আছি। তারা সবাই প্রভু, নাগরিকেরা সবাই তাদের দাস।

এসব ঘটনা দেখে ১৯৭৫ সালে জয়দেবপুরে শ্রমিক সমাবেশে সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে দেওয়া জাতির পিতার একটা ভাষণ অনেক প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকুরি করেন। আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। এই বেটা কোথা থেকে আসলি? সরকারি কর্মচারীদের বলব, মনে রেখ এটা স্বাধীন দেশ। এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোকরে দেখবা তার চেহারা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সবচেয়ে সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়।’

ভাষণে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাদের লেখাপড়া করায় কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? আমাদের ইঞ্জিনিয়ার করায় কে? আমাদের সায়েন্স পান করায় কে? আমাদের বৈজ্ঞানিক করে কে? আমাদের অফিসার করে কে? কার টাকায়?’ উত্তরে তিনিই বলেন, ‘বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়।’

সকলের প্রিয় মুজিব ভাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের সরকারি কর্মচারীদের উপনিবেশিক আচরণ। আর তাই বলিষ্ঠ কণ্ঠে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। অথচ বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শুনেছেন বলে মনে হয় না। শুনলেও ধারণ করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ টানা এক দশক রাষ্ট্র ক্ষমতায় । আওয়ামী লীগের আমলে সরকারি কর্মচারীরা যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তা অতীতে কখনো হয় নাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের অনেকবার এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পিছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে জনগণ তার ন্যায্য সেবাটুকু পায়। কিন্তু জনগণ সেবা কতটুকু পাচ্ছে তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। উপজেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এই নির্বাহী অফিসারদের ভূমিকা কতটা গণমুখী সেটি সেবা গ্রহীতারাই ভাল বলতে পারবেন। আর ইউএনও সাহেবকে স্যার না বললে যে কতটা বিরাগভাজন হতে হয় সেটি বলাই বাহুল্য।

কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। এই খারাপের ভিড়ে অনেক ভালো কর্মকর্তার উদহারণ ও আছে। জেলার প্রধান কর্তা ব্যক্তিটি জেলা প্রশাসক। প্রশাসনের মধ্যম শ্রেণির কর্মচারী জেলা প্রশাসকদের আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে আমরা প্রাচীন জমিদারি প্রথার মধ্যে বসবাস করছি। সাধারণ মানুষ এবং তাদের মধ্যে এক বিশাল দেয়াল বিদ্যমান। আর স্যার সম্বোধনই যেন এর নির্ণায়ক।

মজার বিষয় হচ্ছে যে, ইংরেজ দেশে থেকে স্যার শব্দের আমদানি সেখানে কিন্তু ভিন্ন চিত্র। পুলিশ সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে কথা শুরুই করে স্যার সম্বোধন করে। স্যার শব্দটার সাথে সেই সমাজে শ্রদ্ধার সম্পর্ক। অপরিচিত কারো নাম না জানা থাকলে সেখানে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে স্যার ডাকা হয়।

আপনারা জেনে থাকবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সেখানকার নাগরিকেরা সম্বোধন করেন মিঃ প্রেসিডেন্ট বলে। অথচ আমাদের দেশে এই শব্দের সাথে মিশে আছে ভয়, অন্যায় আচরণ। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। গত বছর জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদেরকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে বলেছিলেন। সেই নির্দেশ শুধু নির্দেশ না থেকে বাস্তবায়ন হোক। প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মচারীগণ উপনিবেশিক আচরণ পরিহার করে জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলুক এটাই সবার প্রত্যাশা।

 

লেখকঃ শেখ রফিকুন্নবী (শিক্ষার্থী)

 গ্রাডুয়েশন ইন ব্রিটিশ ল, বিপিপি ইউনিভার্সিটি।