অপরাধ ও দুর্নীতি ১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০৩:০৭

প্রভাব বিস্তারে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার

ডেস্ক রিপোর্ট।। 

সম্পত্তি রক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন তথাকথিত ভিআইপিরা। দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরুর পর অস্ত্রসজ্জিত দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি অস্ত্রধারী প্রহরীদের নিয়োগ চুক্তিও বাতিল করা হচ্ছে।

মূলত বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য অথবা অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। সেই অস্ত্র দিয়ে অন্যের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকরি করেন তারা।

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে অভিযান চালিয়ে কথিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমসহ তার ৭ দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

আলোচিত ওই ঠিকাদারের ৭ দেহরক্ষীকে গ্রেফতারের ২৪ দিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে কারও দেহরক্ষী হওয়া যাবে না। এমনকি বেসরকারি সংস্থায় নিরাপত্তাকর্মীর চাকরিতেও সেই লাইসেন্স ব্যবহার করা যাবে না।

এ পর্যন্ত দুর্নীতি বিরোধী ৪৯টি অভিযানে ২০টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব-পুলিশ। অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, ক্যাসিনো বাণিজ্যের মূল হোতা সেলিম প্রধান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানদের কাছে থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেন র‌্যাব সদস্যরা। এরা প্রায় সবাই দেহরক্ষীর হাতে অস্ত্র দিয়ে মাস্তানি করতেন।

র‌্যাব সূত্র বলছে, অভিযানে গ্রেফতার হওয়াদের বিরুদ্ধে অন্যতম একটি মামলা হলো—অবৈধ অস্ত্র মামলা। এসব মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকে অবশ্য অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা বন্ধ করেছেন তথাকথিত অন্য ভিআইপিরা। ভুক্তভোগী দেহরক্ষী কেউ জেলের ঘানি টানছে, কেউ চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছেন।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের অস্ত্রধারী দেহরক্ষী আজাদ ফিরেছেন নিজ গ্রামে। ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক আজাদ জানান, তার ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। রাজিব মাসিক বেতন দিয়ে রেখে ছিলেন তাকে। গ্রেফতারের কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে চাকরির চুক্তি বাতিল করা হয়। তারপর একাধিক এজেন্সি ঘুরে চাকরি পাননি আজাদ। পরে গ্রামে ফিরে গেছেন।

এখন প্রশ্ন উঠছে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া কি খুব সহজ? নীতিমালাতেই বা কী আছে?

তথ্য বলছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান ৩ (খ)-তে আছে, অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে আগ্রহী ব্যক্তির বয়স হতে হবে ৩০-এর উপরে এবং ৭০-এর নিচে। ‘ব্যক্তি শ্রেণির’ আয়করদাতা হতে হবে। আবেদনকারী কর্তৃক আবেদনের পূর্ববর্তী দুই বছর ও আবেদনের বছর মিলিয়ে প্রতি বছর ন্যূনতম তিন লাখ টাকা কর পরিশোধ থাকলে রিভলবার বা পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একইভাবে শটগানের জন্য ন্যূনতম ১ লাখ টাকা (তিন বছর) আয়কর দিতে হবে।

তবে কোনো ব্যক্তি দুটির বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স কখনোই পেতে পারেন না। আর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানকে। আর যারা সেই অস্ত্র ব্যবহার করবেন, তাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সুপারিশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে।

তবে সর্বোপরি নীতিমালা ‘গ’-তে উল্লেখ রয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। অভিযোগ আছে, আবেদন করলেই পাওয়া যায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স। টাকা খরচ করে সহজেই মালিক হওয়া যায় বৈধ অস্ত্রের।

র‌্যাব-পুলিশের দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অনেকে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স কিনে সেই অস্ত্র ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। অপরাধের কাজে ব্যবহার করছেন।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা আছে, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সধারী কোনো ব্যক্তি নিজ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা সম্পত্তি রক্ষার জন্য অস্ত্রধারী প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারবেন না। অথচ জি কে শামীম ও কাউন্সিলার রাজীবের দেহরক্ষী নিয়োগের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।

জানতে চাইলে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল উদ্দিন বলেন, আইন অনুযায়ী কখনোই একজনের অস্ত্র আরেকজন ব্যবহার করতে পারবেন না। সে বডিগার্ড হোক আর যেই হোক। কেননা প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টির প্রয়াস থাকে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, অবৈধ অস্ত্রের সরাসরি ব্যবহারের চেয়ে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বেশি ভয়ঙ্কর। ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে অন্যের নিরাপত্তা দেওয়া আইনত অপরাধ।