অপরাধ ও দুর্নীতি ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০৩:৪১

অভিযানে উদ্ধার ৫৬ লাখ টাকা, এজাহারে ১৮ লাখ! (ভিডিও)

ডেস্ক রিপোর্ট ।। 

রাজধানীর শাহজাহানপুরের দক্ষিণ খিলগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক অভিযানে মাদক ব্যবসায়ী শান্তবাবুকে শতাধিক ইয়াবা ও নগদ ৫৬ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। তবে মামলার এজাহারে ১৮ লাখ টাকা উদ্ধার দেখানো হয়েছে। সরিয়ে ফেলা ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে সোর্সকে ছয় লাখ টাকা দেওয়া হয়। আর ৩২ লাখ টাকা বণ্টন হয় দু’জনের মধ্যে। তারা হলেন– ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (উত্তর) মোহাম্মদ খোরশিদ আলম ও রমনা সার্কেলের পরিদর্শক একেএম কামরুল ইসলাম। এই অভিযানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন পরিদর্শক কামরুল। 

তবে খোরশিদ ও কামরুল ৫৬ লাখ টাকা উদ্ধার হওয়ার তথ্য অস্বীকার করে বলেছেন, ‘টাকা সরানোর প্রশ্নই ওঠে না।’

কামরুল জানান, ১৮ লাখ টাকা উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় সরকারি নিয়ম মেনে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে তাকে। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার হলে লাখে ২০ হাজার টাকা করে পায় মামলার বাদী।

শান্তবাবুর পরিবারের সদস্যরা (নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করা হলো না) নিশ্চিত করেন, ১৮ লাখ নয়, ৫৬ লাখ টাকাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সহকারী পরিচালক খোরশিদ আলম, পরিদর্শক কামরুল ইসলাম, উপপরিদর্শক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আবদুস ছাত্তার, সিপাহী মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, সুলতানা রাজিয়া, মো. সালাউদ্দিন আহমেদ খান এবং অধিদফতরে সাময়িকভাবে নিয়োজিত পুলিশের তিন সদস্যও অভিযানে সরাসরি অংশ নেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হলেও তাদের সবাই অভিযানে সরাসরি অংশও নেননি বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

অভিযানটি হয় গত ১১ সেপ্টেম্বর। সময় সকাল ৯টা। আর ঘটনাস্থল শাহজাহানপুরের ১০ দক্ষিণ খিলগাঁওয়ের একটি আধাপাকা টিনসেড বাসা। মাদক ব্যবসায়ী শান্তবাবুর পুরো নাম মাহবুব হোসেন ওরফে শান্তবাবু।

সহকারী পরিচালক খোরশিদ অভিযানের নেতৃত্ব দেন বলে শাহজাহানপুর থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযান শেষে ঘটনাস্থলে যান খোরশিদ। এ সময় শান্তবাবু, তার মা মমতাজ বেগম ও স্ত্রী বিথী আক্তারকে (আলাপকালে শান্তবাবুর স্ত্রী নিজের নাম বিথী হিসেবে উল্লেখ করেন) জেরা করেন তিনি। ঘটনাস্থলে খোরশিদের উপস্থিতি ও জেরা করার দুটি ভিডিওচিত্র হাতে এসেছে। এছাড়াও অভিযান সংশ্লিষ্ট আরও দুটি ভিডিওচিত্র আছে।

খোরশিদ স্বীকার করেন, অভিযানের শুরু থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না তিনি। পরিদর্শক কামরুল তাকে জানান, নগদ টাকা ও ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। কামরুলের ডাকে সাড়া দিয়েই ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়। খোরশিদ বলেন, ‘অভিযানে সরাসরি উপস্থিত না থাকলেও মামলার এজাহার বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিনিয়র অফিসারদের নাম দেওয়ার চল আছে।’

মোট চারটি ভিডিও চিত্রের (৫১ সেকেন্ড, এক মিনিট ২২ সেকেন্ড, তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ড ও এক মিনিট ২৬ সেকেন্ডের) তথ্য আর অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যের মধ্যে গড়মিল পাওয়া যায়।

ঘটনার দিন বিকালে সহকারী পরিচালক খোরশিদ ও পরিদর্শক কামরুল গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। আসামি, টাকা ও ইয়াবার ছবিও সরবরাহ করেন তারা। গণমাধ্যমের কাছে শান্তবাবুকে মাদকের খুচরা বিক্রেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী ১৮ বান্ডিল টাকা (১৮টি বান্ডিলে ১৮ লাখ টাকা প্রতিটি বান্ডিলে এক হাজার টাকার ১০০টি করে নোট ছিল) উদ্ধার হয়। কিন্তু প্রশ্ন– খুচরা বিক্রেতার কাছে এক হাজার টাকার নোটের এক লাখ টাকা করে ১৮টি বান্ডিল থাকে কী করে?

অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী প্রতি পিস ইয়াবার দাম ২৫০ টাকা। তাহলে কী ন্যূনতম চার পিস করেই কি সবাই কিনেছে। আর এক হাজার টাকার নোটেই সবাই ইয়াবার দাম পরিশোধ করেছে?

চারটি ভিডিও চিত্রের বিশ্লেষণ:

৫১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, পরিদর্শক কামরুল অভিযান চালাচ্ছেন। তবে আকস্মিক অভিযান চালালেও ঠিক যেমনটি হয় সেরকম নয়। ভিডিওচিত্রে অভিযানটি দেখে বেশ সাজানো ও পরিকল্পিত মনে হবে। মূল অভিযানের পরে প্রমাণ তৈরির জন্যই নতুন করে অভিযানটি হয়– ভিডিওটি এমনই তথ্য দিচ্ছে।

এই ভিডিওচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনাস্থলের একটি ঘরে সাদা-কালো প্রিন্টের শার্ট পড়া একজনের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। ওই ঘরের দরজার সঙ্গেই খাঁচায় থাকা কয়েকটি বিভিন্ন প্রজাতির কবুতরের দেখা মেলে। এরপর একপ্রস্থ বারান্দা দেখা যায়। ওই বারান্দা দিয়ে লাল-সবুজ রঙের ব্যাগ হাতে হালকা কফি রঙের গেঞ্জি পরা একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে ভিডিও দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় বারান্দার সংলগ্ন ঘর থেকেই বের হন তিনি। এরপর বারান্দায় পরিদর্শক কামরুলের দেখা মেলে। দরজা বন্ধ এবং দরজার কড়ায় হাত দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তার হাতে ছিল তালা-চাবি।

ভিডিওর তথ্য বলছে, এরপর পরিদর্শক কামরুল দরজায় লাথি মারেন। প্রবেশ করেন ঘরে। আগে থেকেই অগোছালো (তছনছ করা) ঘরে বিছানা, জিনিসপত্র উল্টিয়ে দেখেন। আলমারি খোলেন। আলমারিও অগোছালো দেখা যায়। আলমারির র‌্যাকে হাত দেন। কমলা রঙের একটি শপিং ব্যাগে হাতে নেন। ব্যাগে থাকা সবকিছু মেঝেতে ফেলেন। আরেক র‌্যাক থেকে লাল রঙের একটি ব্যাগ হাতে নেন। এরপর ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু একটা মেঝেতে ফেলেন। পরে মেঝে থেকে হাতে নেওয়ার পর দেখা যায় এক হাজার টাকার নোটের তিনটি বান্ডিল। তিনটি বান্ডিলই লাল ব্যাগে রাখা হয়।

এক মিনিট ২২ সেকেন্ডের আরেকটি ভিডিওচিত্রে শান্তবাবু, তার স্ত্রী, অধিদফতরের কর্মকর্তা ও সোর্সদের কথোপকথন দেখা যায়।

অভিযান টিমের এক নারী সদস্য শান্তবাবুর স্ত্রীকে বলেন, ‘আপনি এখনও ফুল হন নাই। আমার ফুল গভমেন্ট সার্ভিস... ১৫ বছর চলছে।’

বিথী: জানি।

ভিডিওতে দেখা যায়, শান্তবাবুর স্ত্রী বিথী আক্তার তার স্বামীকে উদ্দেশ করে বলছেন, কী উত্তর দিবা বলো... এগুলা কী?

ভিডিওচিত্র যিনি ধারণ করছিলেন তার দিকে নজর গেলে বিথী ভিডিও ধারণ করতে নিষেধ করেন। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘ভিডিও করলে ওই দিকে যেয়ে করেন, আমারে অন্তত না। আমার প্রবলেম আছে।’ এ সময় যিনি ভিডিও ধারণ করছিলেন তিনি বলেন, ‘আপনার প্রবলেম থাকলেও কিছু করার নাই... আপনাকেসহ এখানে... যেহেতু আপনার ঘরে পাওয়া গেছে।’

এ সময় বিথী বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন আছে। আমি এগুলার কোনও কিছুর সঙ্গে জড়িত না।’

ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, শান্তবাবুকে অভিযান টিমের সদস্যরা বলছেন, ‘তুই বলতি যে এসব....।’ শান্তবাবু মাথা নেড়ে বলেন, ‘আমি জানি না।’ টিম সদস্য বলেন, ‘তাহলে কে জানে।’

আরেকজন শান্তবাবুকে বলেন, ‘শান্তবাবু শার্ট পরবা।’

শান্তবাবু: স্যার, স্যার।

অভিযান টিমের সদস্য: আর কোনও স্যার কওয়ার সুযোগ নাই, শেষ। আর সুযোগ নাই। তোমাকে সুযোগ দিছি।

শান্তবাবু: আমি জানি না। আমার...আমার...।

অভিযান টিমের সদস্য: সরি, মাফ করবা। আমার আর সুযোগ নাই।

শান্তবাবু: এইহান থিকা যা করার কইরা দিয়া যান স্যার। আপনারা পারবেন স্যার।

অভিযান টিমের সদস্য: না, না, না।

শান্তবাবু: পারবেন স্যার। এইহান থিকা, আপনারা পারবেন।

অভিযান টিমের সদস্য: আগে হ্যান্ডকাফটা লাগাই। তারপর দেখা যাইবোনে।

শান্তবাবু: আচ্ছা...এইহান থিকা...যা কিছু করার আপনারা...।

অভিযান টিমের সদস্য: আমি তোমারে কিন্তু প্রথমে আইসা কইছি...।

শান্তবাবু: আমি জানি না, আল্লাহর কসম।

অভিযান টিমের আরেক সদস্য: শেষমেষ পাইলাম।

অভিযান টিমের আরেক সদস্য: লাগাইছেন, দুই হাতে লাগাইয়া দেন। দুই হাতে লাগাইয়া দেন।

শান্তবাবু: যা করার কইরা দিয়া যান স্যার।

অভিযান টিমের আরেক সদস্য: আরে...। যেখানে আমাদের বড় স্যাররে, বড় স্যাররে ফোন দিয়া ডাকাইছি মিয়া। আবার কথা কন।

অভিযান টিমের সদস্য: আমি স্যার কতবার বলছিলাম...।

তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্রে সহকারী পরিচালক খোরশিদের উপস্থিতি দেখা যায়।

খোরশিদ: নাম কী তোমার?

শান্তবাবু: মাহবুব হোসেন।

খোরশিদ: মাহবুব হোসেন।

শান্তবাবু মাথা নেড়ে সায় দেন। খোরশিদ এবার শান্তর পাশে বসে থাকা তার স্ত্রীকে উঠে দাঁড়াতে বলে নাম জিজ্ঞেস করেন।

খোরশিদ: আপনার নাম কী।

খোরশিদ: মাহবুব হোসেন তোমার নামে কয়টা মামলা আছে।

শান্তবাবু: একটাই আছে।

খোরশিদ: তোমার একটা মামলা না।

শান্তবাবু: একটাই মামলা, একটায় খালাস।

খোরশিদ: তোমার ওয়াইফের নামে মামলা আছে?

শান্তবাবু: জি।

খোরশিদ: ওই যে...একই সঙ্গে... আচ্ছা। তোমার এখানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান করছে। আলামত পাইছে, ইয়াবা পাইছে।

শান্তবাবু: পাইছে।

এ সময় শান্তবাবুর স্ত্রী পাশ থেকে বলেন, ‘বলো পাইছে।’

খোরশিদ: ইয়াবা পাইছে।

শান্তবাবু: পাইছে স্যার।

খোরশিদ: আরও পাইছে ইয়াবা বিক্রির অর্থ। কত টাকা?

শান্তবাবু: স্যার, আমি জানি না স্যার।

খোরশিদ: তুমি জানো না, তুমি জানো না।

খোরশিদ এবার শান্তবাবুর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, ‘আপনি জানেন কত টাকা।’

বিথী: ওইখানে ১৫, সরি, এইখানে ১০, এইখানে ৫। কথা বলা শেষ না করেই চাদরে মুখ ঢাকেন বিথী।

খোরশিদ: তিন লাখ, ১০ লাখ, পাঁচ লাখ, মোট ১৮ লাখ টাকা। একটা পাওয়া গেছে কবুতরের খোপে।

বিথী: না রুমে।

খোরশিদ: ওখানে পাওয়া গেছে পাঁচ লাখ।

বিথী: হ্যাঁ।

খোরশিদ: এখানে পাওয়া গেছে ১৩ লাখ। আচ্ছা, এই টাকার বৈধ উৎস কি দেখাইতে পারছেন। না, বলতে পারছেন।

শান্তবাবু: এইটা আমার গার্জিয়ানদের।

খোরশিদ: হ্যাঁ, গার্জিয়ান তো কিছু কয় না। বৈধ উৎস দেখাইলে আমার সাক্ষীর সম্মুখেই ফেরত দিয়া দিতাম। বৈধ উৎস দেখাইতে পারছেন? পারছেন কিনা?

বিথী: একটা দিন টাইম দিলে, কাগজপত্র...।

শান্তবাবু: সময় দেন একটা দিন।

খোরশিদ: বৈধ উৎস দেখাতে সময় লাগে। মুখ দিয়া বললেও তো আমরা অনেক কিছু পারি। মুখ দিয়াও তো আপনারা কোনও তথ্য দিতে পারেন নাই। আপনারা মুখেও যদি বলতেন, এই টাকাটা এই পারপাসে। আপনারা যে টাকা আছে সেইটাও তো জানেন না। মানে জানেন না; না, বলবেন না। কারণ এইটা...উৎস হলো মাদক। ঠিক আছে।

খোরশিদ: আপনাদের এইখান থেকে ওই টাকা ছাড়া, আলামত ছাড়া আর কিছু নেওয়া হইছে।

এরপর শান্তবাবু ও বিথীর উদ্দেশে খোরশিদ আলম বলেন, ‘এই দিক, এই দিক তাকান। স্বর্ণের কিছু অলংকার ছিল সেইগুলা কি ফেরত দেওয়া হইছে।

বিথী : হুঁ।

খোরশিদ এবার বিছানায় শুয়ে থাকা শান্তর মা মমতাজ বেগমকে বলেন, ‘চাচি আপনার হাত খরচের টাকা হাতে ছিল। টাকাটা কি ফেরত দেওয়া হইছে।’ তিনি জবাব দেন হইছে।

খোরশিদ: কিছু আপনার, কি বলে হাতের গহনা-টহনা ছিল, পাইছেন?

মমতাজ: হ, পাইছি।

এরপর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের টিমের সদস্য দেখিয়ে খোরশিদ বলেন, ‘এরা কি আপনাদের সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করছে।’

মমতাজ: না।

খোরশিদ: খারাপ ব্যবহার করে নাই। কোনও কিছু নষ্ট করছে। ভাঙচুর করছে। মারপিট করছে।

মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে না বলেন।

পরে খোরশিদ শান্তবাবু ও বিথীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। এর জবাবে দু’জনই মাথা নাড়েন।’

খোরশিদ শান্তবাবুকে বলেন, ‘তুমি দোষী, স্বীকার করো তো।’

শান্তবাবু: স্যার...স্যার...।

খোরশিদ: স্যার কী? তোমার এখানে ইয়াবা পাওয়া যায় নাই? তুমি ইয়াবা খাও না, ব্যবসা করো।

শান্তবাবু: ব্যবসা করি না স্যার, মাঝে মাঝে খাই।

খোরশিদ: মাঝে মাঝে খাও। কই থিকা নিয়া আসো?

শান্তবাবু: এইডা আছে নিজেও বলতে পারবো না স্যার।

এক মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে খোরশিদ, শান্তর স্ত্রী ও মা এবং অধিদফতরের টিম সদস্যদের দেখা যায়। টিম সদস্যরা এ সময় প্লাস্টিকের খালি বক্সগুলো (খাবারের বক্স) খুলে কিছু একটা খুঁজছিলেন।

খোরশিদ শান্তর স্ত্রীকে বলেন, ‘আপনারা বৈধ উৎস দেখান। সাক্ষীর সম্মুখে টাকা হস্তান্তর করে দিয়ে যাবো।’

খোরশিদ: যত যাই বলেন, বৈধ উৎস দেখাইতে হবে। তা না পারলে...।

বিথী: ও মনে খায়। সেই জন্য...।

খোরশিদ: এখন খায়। মাদকের টাকা। আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেব মাদকের ইনফরমেশন পেয়ে তারপরে আসছে। এতোগুলো টাকার যদি কোনও বৈধ উৎস না দেখাতে পারেন তাহলে তো আমাদের কিছু করার নাই। আইনগত ব্যবস্থা যেটা সেটা নিতে হবে আমাদের।

এ সময় টিমের এক সদস্য শান্তর মাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই মহিলা একবার জেল খাটছে গোয়েন্দার কাছে...।’

খোরশিদ: মহিলা।

অধিদফতরের টিম সদস্য: মাল পাওয়া গেছে। পরে ওরে নিয়া গেছে।

অধিদফতরের আরেক সদস্য শান্তবাবুর প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাব ইন্সপেক্টর ওর পার্টনার। সাব ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন হইছে। তারপর বান্দরবান থানায় বদলি হইছে।

খোরশিদ: পুলিশের...।

অভিযানের পর সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া তথ্য ও অসঙ্গতি:

সহকারী পরিচালক খোরশিদ ও কামরুল অভিযান শেষে পৃথকভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মোবাইলফোনে সরাসরি কথা বলেন তারা। ক্ষুদেবার্তাও পাঠান। অভিযান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের অনুরোধ জানান তারা।

পরিদর্শক কামরুল বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে মাহবুবের বাসায় অভিযান চালানো হয়। মাহবুব একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি কবুতর পালন করে সে। কবুতর রাখার ঘরে ইয়াবা ও ইয়াবা বিক্রির টাকা লুকিয়ে রাখে। অভিযানের সময় টাকাগুলো কবুতরের ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়।’

কামরুল ওই সময় আরও বলেন, ‘মাহবুবের বিরুদ্ধে শাহজাহানপুর থানায় দুটি মামলা আছে। কিছুদিন জেলও খেটেছে সে। শুরুতে ইয়াবা সেবন করতো। পরে ব্যবসা শুরু করে। ৬ বছর ধরে ব্যবসা করছে। ১০ বছর ধরে ইয়াবা সেবনের সঙ্গে জড়িত।’

তিনি আর বলেন, ‘শান্তবাবুর স্ত্রী সরকারি চাকরি করেন। বর্তমানে আছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু চাকরির পাশাপাশি মাদকের ব্যবসাও করেন। প্রশ্ন ছিল মাদক ব্যবসার সঙ্গে থাকলে শান্তবাবুর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেননি কেন-এর জবাবে কামরুল বলেন, সরকারি কর্মচারী এ কারণে তাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।’

খোরশিদ বলেন, ‘২০১৩ সালে শাহজাহানপুর থানায় একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল শান্তবাবু। ৬ মাস জেলে ছিল। ‘হোম ডেলিভারি’র মাধ্যমে ক্রেতার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতো সে। শান্তবাবু ১০/১২ জন তরুণের মাধ্যমে ইয়াবার ব্যবসা করতো।’

শান্তবাবু যদি খুচরা বিক্রেতা হন তাহলে তার কাছ থেকে এক লাখ টাকার ১৮টি বান্ডিল উদ্ধার হয় কিভাবে? প্রতিটি বান্ডিলই ১০০টি এক হাজার টাকার নোটেই বা গোছানো থাকলো কি করে? খুচরা বিক্রির পর ব্যাংকে গিয়ে খুচরা টাকা এক হাজার টাকায় পরিবর্তন করতো কি তারা? এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই খোরশিদ ও কামরুলের কাছে।

বিথী আক্তারের বক্তব্য: ‘মামলার এজাহারে ১৮ লাখ টাকা উদ্ধারের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও বেশি। কেন তথ্য গোপন করা হয়েছে জানা নেই আমার। অভিযানের সময় একজন সাংবাদিক ছিলেন। বাসায় ইয়াবা ছিল না। ওই সাংবাদিকের পকেট থেকে ইয়াবা বের করে উদ্ধার দেখানো হয়। আগেও সাংবাদিক আমাদের বাসায় ডিবি-পুলিশ এনেছিলেন। তল্লাশি করেছিলেন। এরআগে, শান্তবাবু যখন গ্রেফতার হয়েছিল তখন আরেক সাংবাদিক তাকে সহযোগিতা করেছিল। ওই সাংবাদিক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করেন। তার সহযোগিতা নিয়ে আগের বার জামিনে বের হয় শান্তবাবু। চ্যানেলটির অফিস কারওয়ানবাজারে।’

বিথী দাবি করেন, ‘শান্তবাবুদের বাসাটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়া গিয়েছিল। শান্তবাবু কোনও কাজকর্ম করে না। এ জন্য আমরা তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছিলাম। সেজন্যও বাসায় টাকা রাখা হয়েছিল।’ অভিযানের সময় সব টাকাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন