সারাদেশ ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ ০৬:৪৭

হাওরের কান্না শুনছে না কেউ!

ডেস্ক রিপোর্ট 

ভাটির দেশ সিলেট মানেই হাওর। প্রাণ বৈচিত্রে ভরা তেমনই এক জলের জনপদ টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু সম্প্রতি মানুষের পরিবেশনাশী কার্যক্রমে বিপন্ন হচ্ছে এই হাওর। 

স্থানীয়রা জানান, কারেন্ট জাল, কোনাজাল, ভেটজাল, লাঠিজালসহ বিভিন্ন নামের জাল দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ নৌকা এখানে মাছ ধরে। মাটি ঘেঁষে জাল টানার কারণে হাওরের নিচের জলজ প্রাণ এবং উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে রাসায়নিক দিয়েও মাছ ধরা হয়। 

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পীযূষ পুরকায়স্থ টিটু বলেন, আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৫০ থেকে ১৭৫ প্রজাতির মাছ ছিল। এখন এর প্রায় ৩০ ভাগই দেখা যায় না।

সম্প্রতি গাছ কাটার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন পীযূষ পুরকায়স্থ। তিনি বলেন, পুরোনো নলবনসহ বেশ কিছু বন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এক শ্রেণির পাখি শিকারি অতিথি পাখি নিধন করছে। বেশ কয়েকটি হোটেলে পাখির মাংসও বিক্রি হয়।

হাওরের কিছু স্থানে কয়লা ও পাথরবাহী নৌযান। এর শ্রমিকরা জানান, হাওরের কিছু পাড়ে কয়লা উত্তোলনের জন্য মেঘালয় পাহাড়ে ডিনামাইটের বিস্টেম্ফারণ ঘটানো হয়। এর প্রলয়ঙ্করী শব্দে প্রকম্পিত হয় চারপাশ। এতে পাহাড়ি ঢলে ওপর থেকে নেমে আসা বালির কারণে ভরাট হচ্ছে হাওর ও তৎসংলগ্ন নদী।

হাওরের দুর্দশার জন্য সেখানে আসা পর্যটকবাহী অনেক ইঞ্জিনচালিত বাহনও দায়ী। আবিদা অ্যান্ড তাহা টাঙ্গুয়া প্রমোদতরী নামে বিলাসবহুল নৌযানে পর্যটকরা রান্নার কাজে ব্যস্ত। ভেতরে কেবিন, দুটি খাট, তিনটি টয়লেট, ৩০০ লিটার পানি ধারণক্ষমতার ট্যাঙ্কও রয়েছে। পুরো জাহাজে আলো ঝলমল করছে। নৌযানটির ছাদে একসঙ্গে দেড়শ' মানুষ অনুষ্ঠান করতে পারে। এখানে গানের জলসারও আয়োজন হয়।

এছাড়া আদিবা অ্যান্ড আদিব নৌপরিবহন, টাঙ্গুয়া নৌপরিবহন, মোহনা নৌপরিবহন, মুক্তা মণি নৌপরিবহনসহ ছোটবড় অন্তত শতাধিক নৌযান টাঙ্গুয়ার বুকে চলছে। বেসরকারি একটি জরিপে দেখা গেছে, ছুটির দিনে এখানে দৈনিক অন্তত ১০ হাজার পর্যটক আসেন, এর ৮০ ভাগই নৌকায় রাত কাটান। এলাকাবাসী জানান, পর্যটকরা প্লাস্টিকের থালা, পলিথিন, চিপস-চানাচুরের প্যাকেটসহ প্রকৃতিবিনাশী উপকরণ ছুড়ে ফেলে দেন হাওরে। সংরক্ষিত এলাকায় উচ্চ শব্দে মাইকও বাজানো হয়। এতে জলজ-স্থলজ জীবের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান পরিবেশবিদরা।

সম্প্রতি ড্রোন থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওরের তলদেশে নানা বর্জ্য। পাখি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে টাঙ্গুয়ায় পাখি কমেছে ৮০ শতাংশ। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের জরিপে দেখা যায়, ২০১৫ সালে এখানে প্রায় দুই লাখ অতিথি পাখি এলেও ২০১৮ সালে আসে মাত্র ৫০ হাজার। অথচ এর আগে ২০০২ সালে এ হাওরে পাঁচ লাখের বেশি শুধু জলচর পরিযায়ী পাখি গুনেছেন বলে জানান ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা ও ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে 'বিশ্ব ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে ইজারা প্রথা বিলুপ্ত করে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। তখন থেকেই শুরু হয় নানান প্রকল্প। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আনসার বাহিনী হাওর পাহারা দিতে থাকে। স্থানীয়রা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিলেই চুপ থাকে।

ম্যাজিস্ট্রেট ১৫ কিলোমিটার দূরে টেকেরঘাটে থাকায় হাওর অনেকটাই অরক্ষিত। স্থানীয়দের নিয়ে গঠিত সমবায় সমিতির কমিটিতে কিছু লোভী লোককে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিএনের সমাজভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এটি কার্যত অরক্ষিত। এছাড়া নিয়ম লঙ্ঘন করে টাঙ্গুয়ার হাওরের হানিয়া ও কলমা বিল ইজারা দেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওর বিপন্ন হওয়ার পেছনে রয়েছে আরও কিছু পুরোনো গল্প। তাহিরপুরের টেকেরঘাটে ১৯৬৬ সালে স্থাপিত চুনাপাথর খনি বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রায় দুই দশক আগে। এতে এখানে কর্মরত প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করায় হাওরকেই জীবিকা নির্বাহের পাথেয় বানান তারা। এত আঘাত সয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর নিজেকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।