মুক্তমত ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৫:১২

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে

বি এম মোজাম্মেল হক:  ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার কোনও মিল ছিল না। যার ফলে রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের প্রথম দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেই দ্বন্দ্ব থেকেই গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন।

তৎকালীন ইসলামিয়া, বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ থেকেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে একত্রিত করে ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একত্রিত হয়ে বাঙালি জাতি তাদের অধিকার ফিরে পাবে না। ১৯৪৭ সালে তরুণ শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে প্রিয় মাতৃভূমির মানুষের ভাষার অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) প্রতিষ্ঠা করেন।

এই ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ কর্মসূচি পালনকালে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রোষানলে বারবার কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হন তিনি।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। তমুদ্দুন মজলিশ ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। বঙ্গবন্ধু এই সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচীতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রতিবাদ করে। ডিসেম্বরে ২১ দফা দাবি সংবলিত একটি ইশতেহার প্রণয়ন করা হয়, যার দ্বিতীয় দাবি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঐতিহাসিক এই ইস্তেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্র্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। উক্ত পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজি এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানালে তার দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে, ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগের সমন্বিত রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। সেদিনের আন্দোলনে তিনি সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট করে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু – অন্য কোন ভাষা নয়’। এসময় বঙ্গবন্ধু সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে নিয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, ‘না’ বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরো একটি ভাষণে জিন্নাহ আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কন্ঠে ‘না, না, না’ শব্দ ধ্বনিত হয়। এরপর থেকেই ভাষা আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে উপনিবেশিক সৈরাচারী পাকিস্তান সরকার জাতির পিতাকে ১১ই সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ করে। পরের বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আরও দুইবার গ্রেফতার করে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন’।

১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে কয়েকজন নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে ২১ ফেব্রুয়ারি এসেম্বলি ভবন ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করেন ছাত্র নেতারা। এদিন পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি মিছিল বের করে। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে ঐ মিছিলে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় রফিক, সফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেককে।

 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন : ‘শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন’।

 

১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।

 

এরপর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করেন বাঙালি জাতি। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেরুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। একই সালে সংসদে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধানের মাধ্যমে পাকিস্তান অধিরাজ্য ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান নাম গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের প্রনীত সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

 

ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এবং জীবনকে উৎসর্গ করা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্বের আর কোনও দেশের মানুষকে ভাষার জন্য এভাবে বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়নি। ভাষা আন্দোলন বাংলার জনগণের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে। এ আন্দোলনই পর্যায়ক্রমে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল, তা পরবর্তী আন্দোলনগুলোর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। মূলতঃ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।

 

লেখক: বি এম মোজাম্মেল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সাবেক সংসদ সদস্য