অপরাধ ও দুর্নীতি ৮ অক্টোবর, ২০২২ ০৩:০০

বেরিয়ে পড়ছে কিংফিশার রেস্টুরেন্টের থলের বেড়াল  

মুক্তার হোসেন ও মাহাবুর রহমান

মুক্তার হোসেন ও মাহাবুর রহমান

তানজিল তুষার 

উত্তরার কিং ফিশার রেস্টুরেনন্টের অভিযানের পর আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়ছে থলের বেড়াল। সামনে চলে আসছে অনেক রাঘব বোয়ালের নাম। অভিযান হওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান  কিংফিশার রেস্টুরেন্টের লেকভিউ বার ও গুলশানে একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি বারের কর্ণধার মুক্তার হোসেনকে ঘিরে চলে আসছে নানা তথ্য। 

জানা যায়, ২০০৮ সালেও বারিধারায় অ্যাভিনিউ নামে একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন এই মুক্তার। এখন কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনেছেন। তার স্ত্রী ও সন্তানরাও সেখানে বসবাস করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভাষ্য, উত্তরার গরীবে নেওয়াজ সড়কের একটি ভবনের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ মদের মজুত করা ছিল তার। এসব মদ ও বিয়ার আমদানির কোনো বৈধ নথি দেখাতে পারেনি বার কর্তৃপক্ষ। যদি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, তাহলে শুল্ক্ক বিভাগের ছাড়পত্রের নথি থাকবে। আর যদি পর্যটন করপোরেশন থেকে নেওয়া হয়, তবে তাদের নথি থাকবে। এমনকি উত্তরার ওই বারের লাইসেন্স ডিবিকে দেখাতে ব্যর্থ হন বারের লোকজন। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কিংফিশার রেস্টুরেন্টের লেকভিউ বারের মালিক মুক্তার হোসেন একজন বড় মাফিয়া। তার কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হওয়ার পেছন অনেক রাঘববোয়াল রয়েছেন। রাঘববোয়ালদের কেউ কেউ প্রশাসনের লোক। এই তালিকায় আছেন রাজনৈতিক নেতাও। তাঁদের আশীর্বাদেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন বড় মাফিয়া। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন বিপুল টাকা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই বারে শত শত বোতল অবৈধ মদ থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তরা সার্কেলের ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক মাহাবুর রহমান। ওই বার থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ নেন তিনি। ওই বারের ম্যানেজারও এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে স্বীকার করেছেন, ওই প্রতিষ্ঠান ঘিরে অনেকের বড় ধরনের বাণিজ্য রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও উত্তরার লেকভিউ বারে মাহাবুর উপস্থিত ছিলেন। ওই বারে অভিযানের পর ৪৫৮ বোতল অনুমোদনহীন বিদেশি মদ ও ৬ হাজার ক্যান বিয়ার উদ্ধারের পর প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে কীভাবে দিনের পর দিন অবৈধ মদের কেনাবেচা চলছিল। এতে সরকারও মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এ ব্যাপারে মাদকের ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক মাহাবুর রহমান  বলেন, অভিযানের আগে থেকে তিনি লেকভিউ বারে ছিলেন না। মালিবাগে নিজের বাসায় অবস্থান করছিলেন। ডিবির অভিযানের খবর পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে সেখানে পাঠিয়েছেন।

লেকভিউ বারের লাইসেন্স আছে জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক জানান, সর্বশেষ যেদিন তিনি ওই বারে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, সেদিন সব মদের বৈধ কাগজপত্র ছিল। পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে মদ আমদানি করা হয়েছে কিনা জানা নেই তার। প্রতি মাসে ওই বার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তারের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। গুলশান-বনানী এলাকায় বারের ওয়েটার হিসেবে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। এক পর্যায়ে গুলশান এলাকার একজন প্রভাবশালীর সন্তানের সঙ্গে তাঁর সখ্য তৈরি হয়। এরপর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে মুক্তারের জীবন। বারের ওয়েটার মুক্তার নিজেই শুরু করেন মদের কারবার।

ঢাকার একটি চারতারকা হোটেলের পরিচালক সমকালকে জানান, বিভিন্ন নিয়মনীতি অনুসরণ করে তাঁদের হোটেলেও বৈধভাবে স্বাভাবিক বেচাকেনা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে মুক্তার এখন পর্যন্ত পাঁচটি জায়গায় বার খুলে ব্যবসা করছেন। সেগুলো গুলশান, উত্তরা, মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। তবে মুক্তারের সব বারে সবসময় বিভিন্ন ধরনের মদের বিপুল সংস্থান থাকে। এতে অন্য বারের মালিকরা বিস্মিত হন। মুক্তারের সব বারের লাইসেন্স রয়েছে কিনা এটা নিয়ে সংশয় থাকে অন্য কারবারিদের। গত বৃহস্পতিবারও যখন ডিবির দল উত্তরায় লেকভিউ বারে অভিযান চালায়, তখন লাইসেন্স দেখাতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। মুক্তারের বার ঘিরে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলেও প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে এসব ম্যানেজ করতেন তিনি। এ ছাড়া সদ্যসাবেক এক সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন মুক্তার।

জানা গেছে, গুলশানে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার স্থলে নতুন কর্মকর্তা বদলি হয়ে এলে আগের কর্মকর্তা মুক্তারের প্রতিষ্ঠানে যেন অভিযান চালানো না হয়, সে ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে যান। কারণ মুক্তার বিভিন্ন প্রভাবশালীর নাম ভাঙিয়ে হুঙ্কার দেন- 'তাঁর প্রতিষ্ঠানে যার হাত পড়বে, সেই হাত পুড়ে যাবে।'

বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ে লেকভিউ বারে অভিযান চালায় ডিবি। সেখান থেকে ম্যানেজারসহ ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মুক্তার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, তিনি দেশেই আত্মগোপনে আছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তি অধিকাংশই সেই বারের কর্মচারী।

ডিবির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, লেকভিউ কর্তৃপক্ষ বারের কোনো লাইসেন্স দেখাতে পারেনি। উত্তরার ওই বারে শত শত ছেলেমেয়ে গানবাজনার নামে ডিজে পার্টি করে। সেখানে বিক্রি হতো অবৈধ মদ। বিষয়টি নিয়ে উত্তরার সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকেও ডিবির কাছে অভিযোগ আসে। পরে সত্যতা যাচাই করার পর বাড়িতে অভিযান চালায় ডিবি।

ডিবির প্রধান জানান, প্রথমে ভবনের সাততলায় যায় ডিবির দল। সেখানে গেলে দেখা যায়, অনেক ছেলেমেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। ভেতরে গেলে দেখা গেল, প্রচুর বিদেশি মদ ও বিয়ার রয়েছে। ৫ ও ৬ তলার দৃশ্য একই ছিল। এসব বিদেশি মদ ও বিয়ার একত্রিত করে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায়, এগুলো তারা কীভাবে দেশে নিয়ে এসেছে? এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্যই ডিবিকে জানাতে পারেনি। এ কারণে ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

মুক্তার হোসেনের কাছে বারের লাইসেন্স রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ডিবির প্রধান বলেন, যখন অভিযান পরিচালনা করেছি তখন ম্যানেজারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ৫ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও লাইসেন্স দেখাতে পারেননি তাঁরা। ম্যানেজার আমাদের বলেছেন, মুক্তার হোসেন মিরপুর, গুলশান, নারায়ণগঞ্জসহ ৫টি বার চালান। সেগুলো একই লাইসেন্সের কিনা- সেটা আমরা জানি না। একই লাইসেন্স দিয়ে হয়তো ৫টি বার তিনি চালাতে পারেন। এটা যাচাই করে দেখতে হবে।

উত্তরার ওই বারে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে কিনা- প্রশ্ন করা হলে হারুন অর রশীদ বলেন, কাদের যাতায়াত ছিল, সে বিষয়ে আমরা তদন্ত করব। এর সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো কোরিয়ান নাগরিক সংশ্নিষ্ট কিনা- সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি।'

এদিকে, গুলশান থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে কিংফিশারের গুলশানের বারের সামনে হানা দেওয়া হয়। অনুমোদন ছাড়া মদ খেয়েছে, এমন ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অভিযানের ঘটনায় গুলশান থানায় করা আরেকটি পৃথক মামলায় মুক্তারকে আসামি করা হয়েছে।

উত্তরায় গ্রেপ্তার যাঁরা: অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- আবু সালেহ, মো. মোহন, মুকুল, মো. সিব্বির আহম্মেদ, রাসেল, মো. রুবেল, রিফাত, ফয়সাল, শরিফুল ইসলাম, রাসেল, জাহিদ হাসান, রওশন জামিল রাসেল, হুমায়ুন কবির, তোফাজ্জেল হোসেন, মো. রিয়াদ হোসেন, আল আমিন, কাইয়ুম, নয়ন দাস, শাওন দাস, আবুল কাসেম মিন্টু, নাহিদ দারিয়া, শান্ত ইসলাম, আলিম উদ্দিন, জালাল উদ্দিন, সাজ্জাদ হোসেন, রহমত আলী, খালেক সাইফুল্লাহ, ইমরান, মো. সাহান শেখ, মো. মোফাজ্জেল, ওবায়েদ মজুমদার, ইবাদত খান, রাইস উদ্দিন, রায়হান ও মাহমুদুল হাসান।