জাতীয় ১৭ অক্টোবর, ২০২২ ০৪:০২

কোন কাজেই আসছে না ‘ডিজিটাল নম্বর’ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের আগস্টে ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা দিয়ে নতুন মোটরসাইকেল কিনেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী ড্রিনজা চাম্বুগং। মোহাম্মদপুরে তার বাসার গ্যারেজে মোটরসাইকেলটি রেখে তিনি তার স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত  ছিলেন। এসে দেখেন তার নতুন মোটরসাইকেলটি গ্যারেজে নেই, চুরি হয়ে হয়ে গেছে। মোটরসাইকেলটিতে ডিজিটাল নম্বর উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন । কিন্তু এটি উদ্ধার কিংবা এর অবস্থানও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ৩ হাজার টাকায় যে ডিজিটাল নম্বর প্লেট দেওয়া হয়েছে, তা কোনও কাজেই লাগেনি গাড়ি উদ্ধারে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা আছে, তারা মোটরযানের জন্য যে নম্বর প্লেট দেয়, সেটিতে রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বর প্লেট ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ থাকে। আরএফআইডি হলো একধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উইন্ডশিল্ড স্টিকার, যা মোটরযানের উইন্ডশিল্ডে ভেতরের দিক থেকে সেলফ এডহেসিভ দ্বারা লাগানো হয়। এই ট্যাগ মোটরযান ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর দ্বারা মোটরযানের অবস্থান জানা সম্ভব এবং এক মোটরযানে সংযোজিত ট্যাগ অন্য মোটরযানে ব্যবহার করা যায় না।

ডিজিটাল নম্বর প্লেটের জন্য মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানকে দিতে হয় ২ হাজার ২৬০ টাকা ও চার চাকার গাড়িকে দিতে হয় ৪ হাজার ৬২৮ টাকা। কিন্তু মোটরযান মালিকরা জানিয়েছেন, মোটরযান চুরি প্রতিরোধ, অপরাধে ব্যবহৃত মোটরযান শনাক্তকরণ ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীকে শনাক্ত কোনোটিই করা হচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেবার নামে প্রতারণা করছে।

গত বছর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে একটি প্রাইভেট কার চুরি হয় হয় ফিরোজ আল মামুন নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর। তিনি গাড়ি উদ্ধারে ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন। তিনি বলেন, গাড়ি হারিয়ে যাওয়ার পর এর অবস্থান নিয়ে কোনও তথ্য আমাকে দিতে পারেনি পুলিশ। পরে অবশ্য গাড়িটি পেয়েছিলাম, সেটা ট্র্যাকিং করে নয়, চোরদের সন্দেহজনক আচরণের কারণে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্যাগের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, চ্যাচিস নম্বর ও মোটরযানের ধরন-সংক্রান্ত কোড থাকে, ফলে এ ট্যাগযুক্ত কোনও মোটরযান কোনও আরএফআইডি স্টেশন অতিক্রমকালে স্টেশনে অবস্থিত এনটেনা ওই কোড বা সিগন্যাল স্টেশনে অবস্থিত অপর একটি ডিভাইস আরএফআইডি রিডারে পাঠায় এবং রিডার তা নেটওয়ার্ক কানেকটিভিটির মাধ্যমে সেন্ট্রাল সার্ভারে পাঠায়। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মোটরযানের অবস্থানসহ যাবতীয় তথ্য দৃশ্যমান হয়।

ভুয়া নম্বর প্লেট, মোটরযান চুরি প্রতিরোধ ও অপরাধে জড়িত মোটরযান শনাক্তকরণের জন্য মোটরযানে রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপ্লেট প্রবর্তন করা হয়। একই সময়ে মোটরযানের অবস্থান, মোটরযানের গতিবিধি মনিটর ও মোটরযানের রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সংবলিত মোটরযানে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ সংযোজন কার্যক্রম চালু করা হয়।

২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর উদ্বোধনের মাধ্যমে মোটরযানে রেট্রো-রিফ্লেকটিভ নম্বর প্লেট, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন ট্যাগ কার্যক্রম চালু করা হয়। এরই মধ্যে ঢাকায় ১২টি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডিন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৬ হাজার ৩৬ সেট রেট্রো-রিফ্লেকটিভ নম্বর প্লেট প্রস্তুত করা হয়েছে এবং ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৩২২ সেট মোটরযানে সংযোজন করা হয়েছে। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৪ হাজার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ১৭ হাজার আরএফআইডি প্রস্তুত করেছিল সংস্থাটি।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উত্তর বিভাগের উপকমিশনার আবু রায়হান বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে মোটরযানের অবস্থান শনাক্তকরণের জন্য কোনও ডিভাইস আমাদের দেওয়া হয়নি। মামলা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা শুধু পজ মেশিন ব্যবহার করি।’

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শামসুল আলম বলেন, ‘আরএফআইডি টাওয়ার থেকে যে ডাটা আসে, তা ব্যবস্থাপনা করার জন্য জনবল নেই। যে ডাটাগুলো আসবে, সেগুলো কে দেখবে? এ প্রযুক্তি উন্নত বিশ্বে অনেক আগ থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেবা না দেওয়া একটি প্রতারণা। সরকার শুধু প্রকল্পের পর প্রকল্প করে। কেন আগের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলো না, সে খেয়াল কেউ রাখে না। এটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা।’

বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএ-র মুখপাত্র মাহবুবে রব্বানীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনও সেবার প্রতিশ্রুতি ছিল না।’ পরে বিআরটিএ-র ২০২১-২২ অর্থবছরের রিপোর্ট তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠানো হলে তিনি বিষয়টি অবহিত হন। কিন্তু পরে এ বিষয়ে তিনি আর মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ-র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘এ প্রযুক্তি যে একেবারেই ব্যবহার হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে টোল আদায়ের ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। বাকি বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নেবো।

 

আমাদের কাগজ//টিআর