অপরাধ ও দুর্নীতি ১৮ অক্টোবর, ২০২২ ০২:৩০

আশা ইউনিভার্সিটি

রেজিস্ট্রার-পিয়নের যোগসাজসে গোপন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল

নিজস্ব প্রতিবেদকযৌন হয়রানির সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে রাজধানীর আশা ইউনিভার্সিটির নাম। প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রার আশরাফুল হক চৌধুরী ওরফে তানভীর যা করেছেন, তা এককথায় নজিরবিহীন।

তার পরিকল্পনায় রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরেই একের পর এক ছাত্রীর নগ্ন ভিডিও ধারণ করে কর্মচারী আমিনুল ইসলাম। এর পর সেই ভিডিও দেখিয়ে ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করেন তানভীর। অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হলে তাদের মানসিকভাবে নাজেহাল করা হতো। শিক্ষাজীবন শেষ না করেই বিদায় নিতে হবেএমন হুমকিও পেয়েছেন কেউ কেউ।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রীরা যেসব বাথরুম ব্যবহার করেন, সেসব বাথরুম থেকেই গোপনে মোবাইলে ধারণ করা হয় এসব ভিডিও। তানভীর চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আশা ইউনিভার্সিটির এমএলএসএস আমিনুল ইসলাম কৌশলে বাথরুমের ভেতর ক্যামেরা স্থাপন করে রাখত। ভিডিও ধারণ শেষে তা কম্পিউটারে নিয়ে এডিট করে ফাঁকা অংশ কেটে ফেলে শুধু ছাত্রীদের অংশটুকু রেখে দেওয়া হতো। এরপর শুরু হতো ব্ল্যাকমেইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মচারী অনৈতিক কাজের বিষয়টি জানত। তবে আমিনুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছের লোক হওয়ায় কেউই মুখ খুলত না।

আমিনুল জানায়, রেজিস্ট্রার তানভীরের নির্দেশেই সে বাথরুমে মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা চালু করে রেখে আসত। এর পর মোবাইলে ধরা পড়ত ছাত্রীদের নানা ভিডিও। আমিনুল দাবি করে, প্রতি ভিডিওর জন্য তাকে তিন-চারশ টাকা দিতেন তানভীর। ছাড়া চাকরি করতে হলে ধরনের ভিডিও করতে হবে কথা বলে তাকে চাপে রাখা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মচারী হয়ে মালিকের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সাধ্য ছিল না তার।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কৌশলে মোবাইল ক্যামেরা ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বাথরুম থেকে কমপক্ষে ৫০ মেয়ের নগ্ন ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। ধরনের ২০টি ভিডিও কালবেলার কাছে এসেছে। এসব ভিডিও দেখিয়ে তানভীরের ব্ল্যাকমেইল চেষ্টার দুঃসহ বর্ণনা দিয়েছেন কয়েকজন ছাত্রী। ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় কেউই মুখ খুলছেন না, বেশিরভাগই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

আশা ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, অনেক ছাত্রী হয়তো নিজেরাই জানেন না, তাদের ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। এর পর ক্লাসে কম উপস্থিতি বা অন্য কোনো দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওই ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করা হতো। আর যারা এরই মধ্যে ভুক্তভোগী হয়েছেন, তারাও শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মুখ খুলছেন না।

শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর নগ্ন ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও বীরদর্পে আশা ইউনিভার্সিটি পরিচালনা করে যাচ্ছেন তানভীর চৌধুরী। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অন্য সদস্যদের পাত্তাই দেন না তিনি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে আশা ইউনিভার্সিটিতে কোনো নিয়োগ বা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না।

জানা যায়, আশা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সফিকুল হক চৌধুরীর ছেলে আশরাফুল হক চৌধুরী ওরফে তানভীর। বাবার মৃত্যুর পর ইউনিভার্সিটির হাল ধরেন তিনি। রেজিস্ট্রার পদে থাকলেও মূলত তার নির্দেশনায়ই বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে ইউনিভার্সিটিটি। ছাত্রীদের নগ্ন ভিডিও ধারণসহ তানভীরের নানা অপকর্ম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওপেন সিক্রেট হলেও বিষয়ে মুখ খুলতে চান না শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল আকর্ষণীয়। তবে কয়েক বছর ধরে এখানকার শিক্ষার মান পড়তির দিকে। ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সফিকুল হক চৌধুরীর মৃত্যুর পর তানভীরের হাতে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। রেজিস্ট্রারের পাশাপাশি তিনি একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য সচিবের দায়িত্বও পালন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, আশা ইউনিভার্সিটিকে অনেকটা পারিবারিক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করেন তানভীর। যথেচ্ছভাবে অর্থের ব্যবহারের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের মধ্যে মাদকের আসর বসান।

গোপনে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে ২০২১ সালে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির এক ছাত্রী। মামলায় আমিনুল ইসলাম তানভীর চৌধুরীকে আসামি করা হয়। এজাহারে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, দুটি রিট্যাক্ট সাবজেক্টের রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রার তানভীর চৌধুরী স্যারের কাছে যাই। তানভীর স্যার রেজিস্ট্রেশন করতে অনীহা প্রকাশ করে জানান, কো-অর্ডিনেটর ডিনকে রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে তানভীর স্যারকে বলতে হবে, তখনই তানভীর স্যার রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি দেবেন। পরে কো-অর্ডিনেটর এবং ডিন স্যারকে ফোন করলে জানতে পারি, তানভীর স্যার তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে নিষেধ করেছেন। এর পর আমি তানভীর স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে যাই। রুম থেকে বের হওয়ার পর আমিনুলের সঙ্গে দেখা হয়।

আমিনুল আমাকে একটু নিরিবিলি স্থানে আসার কথা বলার পর আমি তার কথামতো ওই স্থানে যাই। এর পর সে মোবাইল বের করে আমার ওয়াশরুমে থাকার একটি ভিডিও দেখায় এবং বলে ভিডিওর দৃশ্যমান মানুষটি আমি কিনা? আমি হ্যাঁ বললে সে আমাকে রেজিস্ট্রার তানভীর চৌধুরীর সঙ্গে একান্তে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর কথা বলে। সে বলে, তানভীর স্যারের নির্দেশে সে ভিডিও ধারণ করেছে। আমিনুলের প্রস্তাবে আমি আপত্তি জানালে আমার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং দুটি রিট্যাক্ট রেজিস্ট্রার নেবেন না বলে হুমকি দেওয়া হয়। পরে বিষয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের মাধ্যমে জানতে পারি, তানভীর স্যারের নির্দেশে আমিনুলকে দিয়ে অনেক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন হয়রানির উদ্দেশ্যে ভিডিও ধারণ করা হয়।

মামলাটি তদন্ত করে ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নিজের অপকর্মের কথা স্বীকার করে আমিনুল। তবে নির্দেশদাতা তানভীরকে গ্রেপ্তার না করে তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তদন্তের পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হলেও তাতে রহস্যজনকভাবে তানভীরের নাম বাদ দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। অভিযোগ পেয়ে আমিনুল রেজিস্ট্রার তানভীরকে ডেকে নেয় ডিবি পুলিশ। আমিনুল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। আমিনুলকে আটক করা হলেও তানভীরকে তার মা ডিবি অফিস থেকে ছাড়িয়ে নেন।

বিষয়ে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আশা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের নগ্ন ভিডিও ধারণের মামলাটির চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে কাকে আসামি করা হয়েছে, তা এখন আর মনে নেই। মামলার পর পুলিশ ভিডিও ধারণে ব্যবহৃত একটি ওয়ালটন প্রিমিও মোবাইল ফোন, দুটি সিম, একটি মেমোরি কার্ড নগ্ন ভিডিওর বেশ কয়েকটি ক্লিপ জব্দ করে। মামলার জব্দ তালিকায়ও এগুলোর উল্লেখ রয়েছে।

মামলার সাক্ষী আশা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবিএম মাহমুদুল বসরী জন বলেন, ওই মামলায় সাক্ষী হওয়ায় নানা তালবাহানা করে আমার পরীক্ষা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। আমি নানাভাবে যোগাযোগ করেও সমাধান করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রীদের নগ্ন ভিডিওসহ নানা অপকর্মের প্রমাণ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, দায়িত্বশীল পদে থাকা একজন এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি নির্দয় আচরণ করছে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে তানভীরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

আশা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মো. ইকবাল খান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আমাদের কাছে বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। ওই ছাত্রী যেহেতু আইনের আশ্রয় নিয়েছেন, আদালতই সেটা দেখবেন।

 

সূত্র:দৈনিক কালবেলা

 

আজকের কাগজ/টিআর