দুর্যোগ ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:৪২

ঘূর্ণিঝড়ে প্রস্তুতি ও করণীয় 

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি ও এর বিপদ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখার পাশাপাশি ঝড় আঘাত আনার সময়ে করণীয় সম্পর্কে উপকূলের বাসিন্দাদের সতর্ক করা হতে পারে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এমনটাই বলছে আবহাওয়াবিদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীরা।

ঝড়-জ্বলোচ্ছ্বাস প্রবণ বাংলাদেশে মূলত এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝড় ও প্রচুর বৃষ্টিপাত হতে পারে। ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধস ঘটতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও গতিপথ অনুযায়ী বন্দরগুলোতে জারি করা হয় বিপদ সংকেত। সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়।

ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় উপকূলের নিচু এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বসে প্লাবিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিচু এলাকায় পাকা দালানে থেকেও বিপদ ঘটতে পারে। সুতরাং কর্তৃপক্ষের পরামর্শ মেনে দেরি না করে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়া উচিৎ।

উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের আগে পাঠাতে হবে। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় টর্চ লাইট, দেশলাইসহ মোমবাতি, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি

ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রকে ‘চোখ’ বলে। আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি দুর্যোগপূর্ণ থাকে ওই ‘চোখ’এর চারদিকের এলাকায়। ওই এলাকাকে বলে ‘চক্ষুপ্রাচীর’। যে মেঘবলয় কুণ্ডলী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয় তাকে কুণ্ডলীগত বৃষ্টিবলয় বলা হয়। এগুলো ঘূর্ণিঝড়ের সামনে ডান-চতুর্থাংশে অতি ভারি বৃষ্টিপাত ও প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া এবং এমনকি কি টর্নেডোও সৃষ্টি করে থাকে।

ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের যেখানে কম মেঘ থাকে, সেখানে অনেক সময় ১০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ঝড়ের ‘চোখ’ দেখা যায়। এ ‘চোখ’ অতিক্রমকালে সাময়িকভাবে অতি হালকা বৃষ্টিপাত ও সামান্য বাতাসসহ আবহাওয়া শান্ত থাকার সম্ভাবনা থাকে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আগে করণীয়

দুর্যোগের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবে, গবাদিপশু কোথায় থাকবে, তা আগে ঠিক করে রাখুন এবং জায়গা চিনিয়ে রাখুন। বাড়িতে, গ্রামে, রাস্তায় ও বাঁধের ওপর গাছ লাগান।

যথাসম্ভব উঁচু স্থানে শক্ত করে ঘর তৈরি করুন। পাকা ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিয়ে তার ওপর ছাউনি দিন। ছাউনিতে টিন ব্যবহার না করা ভালো। কারণ ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদিপশু আহত করতে পারে। তবে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার পুরুত্ববিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করা যেতে পারে। উঁচু জায়গায় টিউবওয়েল স্থাপন করুন, যাতে জলোচ্ছ্বাসের লোনা ও ময়লা পানি টিউবওয়েলে ঢুকতে না পারে। জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারে রেডিও রাখুন। সকাল, দুপুর ও বিকেলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন। সম্ভব হলে বাড়িতে কিছু প্রাথমিক চিকিত্সার সরঞ্জাম (ব্যান্ডেজ, ডেটল প্রভৃতি) রাখুন। জলোচ্ছ্বাসের পানির প্রকোপ থেকে রক্ষার নানারকম শস্যের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন। 

বাড়িতে ও রাস্তায় নারকেল, কলাগাছ, বাঁশ, তাল, কড়ই ও অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান। এসব গাছ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ কমিয়ে দেয়। ফলে মানুষ দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচতে পারে। নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে প্রত্যেকেরই সাঁতার শেখা উচিত।

আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ঘরের মধ্যে একটি পাকা গর্ত করুন। জলোচ্ছ্বাসের আগে এই পাকা গর্তের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারবেন। ডায়রিয়া মহামারির প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে কীভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হবে, সে বিষয়ে পরিবারের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেন।

ঘূর্ণিঝড়ের মাসগুলোতে বাড়িতে মুড়ি, চিড়া, বিস্কুটজাতীয় শুকনো খাবার রাখা ভালো। নোংরা পানি কীভাবে ফিটকারি বা ফিল্টার দ্বারা খাবার ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, সে বিষয়ে নারীদের এবং আপনার পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন।

ঘূর্ণিঝড়ের পরে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করুন। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। মাটির বড় হাঁড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালোভাবে আটকে রাখতে হবে, যাতে পোকা-মাকড়, ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে না পারে।

পূর্বাভাস পাওয়ার পর দুর্যোগকালে করণীয়

আপনার ঘরগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করুন। আরও মজবুত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যেমন: মাটিতে খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘরের বিভিন্ন অংশ বাঁধা।

সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন। বিপদ সংকেত পাওয়া মাত্র বাড়ির নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের আগে নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে পোঁছে দিতে প্রস্তুত হোন এবং অপসারণ নির্দেশের পরে সময় নষ্ট না করে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যান। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় আগুন নিভিয়ে যাবেন।

আপনার অতি প্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যসামগ্রী যেমন—ডাল, চাল, দেশলাই, শুকনো কাঠ, পানি ফিটকিরি, চিনি, নিয়মিত ব্যবহূত ওষুধ, বইপত্র, ব্যান্ডেজ, তুলা, ওরস্যালাইন ইত্যাদি পানি নিরোধন পলিথিন ব্যাগে ভরে গর্তে রেখে ঢাকনা দিয়ে পুঁতে রাখুন।

আপনার গরু-ছাগল নিকটস্থ উঁচু বাঁধে অথবা উঁচু স্থানে রাখুন। কোনো অবস্থায়ই গোয়ালঘরে বেঁধে রাখবেন না। কোনো উঁচু জায়গা না থাকলে ছেড়ে দিন, বাঁচার চেষ্টা করতে দিন। শক্ত গাছের সঙ্গে কয়েক গোছা লম্বা মোটা শক্ত রশি বেঁধে রাখুন। রশি ধরে অথবা রশির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখুন, যাতে প্রবল ঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিতে না পারে।

আশ্রয় নেওয়ার জন্য নির্ধারিত বাড়ির আশপাশে গাছের ডালপালা আসন্ন ঝড়ের আগেই কেটে রাখুন, যাতে ঝড়ে গাছগুলো ভেঙে বা উপড়ে না যায়। রেডিওতে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনতে থাকুন।

দলিলপত্র ও টাকা-পয়সা পলিথিনে মুড়ে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখুন অথবা সুনির্দিষ্ট স্থানে পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখুন। টিউবওয়েলের মাথা খুলে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং টিউবওয়েলের খোলা মুখ পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে আটকে রাখতে হবে, যাতে ময়লা বা লবণাক্ত পানি টিউবওয়েলের মধ্যে প্রবেশ না করতে পারে।

দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয়

রাস্তাঘাটের ওপর উপড়ে পড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলুন, যাতে সহজে সাহায্যকারী দল আসতে পারে এবং দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করুন এবং নিজের ভিটায় বা গ্রামে অন্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিন।

অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যাতে শুধু এনজিও বা সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজে যেন অন্যকে সাহায্য করে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।

ত্রাণের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট হোন। ত্রাণের পরিবর্তে কাজ করুন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করুন। রিলিফ যেন মানুষকে কর্মবিমুখ না করে কাজে উত্সাহী করে, সেভাবে রিলিফ বিতরণ করতে হবে। দ্বীপের বা চরের নিকটবর্তী কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে লোক উদ্ধারকাজ শুরু করুন। কাদায় আটকে পড়া লোকের কাছে দড়ি বা বাঁশ পৌঁছে দিয়ে তাঁকে উদ্ধারকাজে সাহায্য করা যায়।

ঝড় একটু কমলেই ঘর থেকে বের হবেন না। পরে আরও প্রবল বেগে অন্যদিক থেকে ঝড় আসার আশঙ্কা বেশি থাকে। পুকুরের বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন। নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বণ্টন (আলাদা লাইনে) করুন। দ্রুত উত্পাদনশীল ধান ও শাক-সবজির জন্য জমি প্রস্তুত করুন, বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষিকাজ শুরু করুন, যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে।

আমাদের কাগজ//জেডআই