সারাদেশ ১০ নভেম্বর, ২০২২ ১০:৩৭

বান্ধবীর ম্যাসেজ নিয়ে ধোয়াসায় আছে প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক: পরশের হত্যার বিষয়ে, কে বা কারা কেন তাঁকে হত্যা করেছে- এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধারের পর তিন দিনেও হত্যারহস্যের জট খোলতে পারেনি প্রশাসন। এমনকি এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। 

ফারদিনের মোবাইল ফোনে সর্বশেষ একটি মেসেজ (খুদেবার্তা) পাঠান তাঁর বান্ধবী। গত শুক্রবার রাত ১০টা ৫৯ মিনিটে পাঠানো ওই মেসেজে তাঁর বান্ধবী জানতে চান- ফারদিন ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছেন কিনা। উত্তরে ফোনের ওপাশ থেকে এক শব্দে 'হ্যাঁ' লেখা হয়। মেসেজের সঙ্গে 'ভালোবাসা'র চিহ্ন পাঠানো হয়। নিখোঁজের পর থেকে ফারদিনের বান্ধবী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলে আসছেন, শুক্রবার রাত ১০টা ৯ মিনিটে রামপুরা ব্রিজের কাছে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে আসেন ফারদিন। তখন তিনি বলছিলেন- পরদিন শনিবার পরীক্ষা রয়েছে। তাই বাসায় না ফিরে ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন। ১১টার দিকে ফারদিনের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে ঠিকমতো পৌঁছেছেন কিনা, তা জানতে চেয়েছেন। গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে একই তথ্য দেন ওই তরুণী। তিনি এখনও ডিবি হেফাজতে রয়েছেন।


প্রযুক্তিগত বিশ্নেষণে তাঁর মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থান পাওয়া গেছে ঢাকার জুরাইন। অথচ তাঁর লাশ মিলেছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে; শীতলক্ষ্যায়। মধ্যবর্তী সময়ে কী ঘটেছে, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় রয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা।


পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শুক্রবার বান্ধবীকে পৌঁছে দিয়ে ফারদিন ক্যাম্পাসে যাননি। তাহলে কেন বান্ধবীর প্রশ্নের জবাবে 'হ্যাঁ' সূচক জবাব দিলেন? ফোনটি কি তখন ফারদিনের কাছে ছিল; নাকি অন্য কেউ তা দখলে নেয়- এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আবার এটাও ধারণা করা হচ্ছে, বুয়েটের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন।

ফারদিনের বন্ধু তানিম সমকালকে বলেন, ফারদিনের মতো ভালো ছেলে খুব কম দেখেছি। ক্লাসে ওর রেজাল্ট বেশ ভালো। আমরা তো ওর মৃত্যুর কোনো ক্লু পাচ্ছি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ বলেন, ঠিক কোন স্থানে ফারদিনকে হত্যা করা হয় বা তাঁর মৃত্যু ঘটে; এখনও জানা যায়নি। আবার এটি যে হত্যাকাণ্ড- সেটিও শতভাগ নিশ্চিত নয়। ফলে সব সম্ভাবনা মাথায় রেখেই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, দ্রুতই রহস্যের জট খুলবে।

তদন্ত-সূত্র জানায়, ফারদিনকে সর্বশেষ রামপুরা এলাকায় দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবারের লোকজন। মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করে আরও কিছুদূর তাঁর গতিপথ শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু এর পরের ঘটনাপ্রবাহ জানা যায়নি। তাঁকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, সেটিও নিশ্চিত নয়। শীতলক্ষ্যায় যে স্থানে লাশটি পাওয়া গেছে, সেখানে বা আশপাশেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, অন্য কোথাও হত্যার পর তাঁর লাশ নদীতে ফেলা হয়। সেই লাশ ভাসতে ভাসতে ওই স্থানে যাওয়ার পর সবার নজরে আসে। মরদেহ বিকৃত হতে শুরু করায় বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে লাশ উদ্ধারের অনেকটা সময় আগে। সম্ভবত নিখোঁজ হওয়ার দিনই তাঁকে হত্যা করা হয়।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ফারদিনের বান্ধবী জানিয়েছেন, ৫ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁদের মধ্যে পরিচয়। দু'জনই বিতার্কিক- এর সূত্র ধরে চেনাজানা হয়েছিল। তবে তাঁদের মধ্যে স্রেফ ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে এরই মধ্যে ফারদিনের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পরীক্ষা চলছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, বুয়েটের কোনো সহপাঠীর সঙ্গে বিরোধ, ছিনতাইকারী বা অজ্ঞান পার্টির শিকার হওয়া, আর্থিক, জঙ্গি ও মাদক-সংক্রান্ত কোনো ইস্যু জড়িত কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বললেও মৃত্যুর অন্য কারণ আছে কিনা, তাও বিশ্নেষণ করা হচ্ছে। ফারদিনের বান্ধবী, চাচাতো ভাই ও বন্ধুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর অন্তত পাঁচজনকে গোয়েন্দারা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আবার ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিনসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সম্ভাব্য সব কারণ সামনে রেখে চলছে তদন্ত। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গে গতকাল একাধিক দফায় কথা বলেছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে ফারদিনের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। চিকিৎসক কী ধরনের আলামত পেয়ে প্রাথমিকভাবে ফারদিনের মৃত্যুকে আঘাতজনিত হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করেছেন- সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিনের লাশ গত সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর আগে শুক্রবার তিনি ঢাকার বাসা থেকে বের হন। এর পর তাঁর কোনো খোঁজ মিলছিল না। সেদিন রাত থেকেই তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাঁর পরিবার। মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ফারদিনের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। পরে চিকিৎসকরা জানান, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
তবে এ ঘটনায় এখনও মামলা করেনি নিহতের পরিবার। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাস্থল, নাকি লাশ উদ্ধারের স্থান- কোথায় মামলা করবেন, সে সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। প্রথম ঘটনাস্থল ঢাকার রামপুরা এবং শেষটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় পড়েছে। অবশ্য দুই থানা পুলিশই বলছে, যে কোনো স্থানে মামলা করতে পারে পরিবার।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত পরিবারের কেউ আসেননি। এলে অবশ্যই আমরা মামলা নেব। রামপুরা থানার ওসি কাজী রফিকুল ইসলাম জানান, ফারদিন নিখোঁজের ঘটনায় জিডির সূত্র ধরেই তাঁরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ পুলিশের ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বুয়েটের ছাত্র ফারদিনের হত্যাকাণ্ডটি ক্লুলেস হিসেবে ধরা যায়। তাঁর দুই বান্ধবী ও চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নৌ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। একাধিক সংস্থা ছায়া তদন্ত করছে।

ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন জানান, ক্যাম্পাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শুক্রবার দুপুরে বাসা থেকে বের হয়েছিল ফারদিন। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরবে বলে জানিয়েছিল। এর পর শুক্রবার রাত ১১টার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় আর যোগাযোগ হয়নি। যারা আমার সোনার টুকরা ছেলেকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলেছে, তাদের বিচার চাই

আমাদের কাগজ/ ইআ