আইন ও আদালত ২৬ নভেম্বর, ২০২২ ০৬:১৭

আয়াতকে হত্যার পর ৬ টুকরা

শনাক্ত-গ্রেফতারের দুদিন পরও আসামি অজ্ঞাত!

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর শিশু আয়াতকে হত্যা করে মরদেহ ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনায় থানায় দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে নতুন করে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। দুদিন আগে আসামি শনাক্ত গ্রেফতার হওয়ার পরও থানায় দায়ের হওয়া মামলায় অজ্ঞাত উল্লেখ করা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) দিনগত রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর ইপিজেড থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়। এজাহারে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করায় মামলার বিচারে অপরাধীরা সুযোগ নিতে পারেন বলেও মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা এলাকায় গত ১৫ নভেম্বের থেকে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছর বয়সী আলিনা ইসলাম আয়াত। ওইদিন খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ইপিজেড থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার বাবা সোহেল রানা। ঘটনায় থানা পুলিশ কোনো ক্লু উদঘাটন করতে না পারলেও ২৪ নভেম্বর দিনগত রাতে ১১টার দিকে ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়ক থেকে আবির আলী নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

আটকের পর পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে শিশু আয়াতকে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে অপহরণের কথা স্বীকার করেন আবির আলী। পরে শ্বাসরোধে হত্যা করে ধারালো বটি এন্টিকাটার দিয়ে মরদেহ ছয় টুকরো করে পাশের সাগর পাড়ের নালা সাগরে ফেলে দেওয়া হয় বলে পিবিআইকে তথ্য দেন। সেই অনুযায়ী পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে নিষ্ফল অভিযান পরিচালনা করে পিবিআই।

শুক্রবার সকালে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকে জানান, ১৫ নভেম্বর অপহরণের পরপরই আয়াত চিৎকার করায় শ্বাসরোধে হত্যা করে আবির আলী। আবির আলী নামের ১৯ বছর বয়সী যুবক আয়াতের দাদার বাসার পুরোনো ভাড়াটিয়া।

শ্বাসরোধে হত্যার পর মরদেহ বস্তাবন্দি করে তাদের বাসার সানসেটে লুকিয়ে রাখেন। পরে বাসার বাথরুমে নিয়ে ধারালো বটি এন্টিকাটার দিয়ে মরদেহ টুকরো টুকরো করে প্যাকেটবন্দি করেন। মরদেহ কাটার পর যাতে রক্ত ছড়াতে না পারে সেজন্য টেপ দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে নেয়। এরপর ১৬ নভেম্বর ভোরে মরদেহের খণ্ডিত কিছু অংশ পাশের আকমল আলী রোড সংলগ্ন নালায় ফেলে দেন। অন্য টুকরোগুলো ফেলে দেন পতেঙ্গা আউটার রিং রোডের পাশের সাগরে।

হত্যাকাণ্ডটি সুপরিকল্পিত হিসেবে উল্লেখ করে পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিশু আয়াতকে হত্যার পর মরদেহ গুমের বিষয়টি হিন্দি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল থেকে রপ্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান আটক আবির আলী। ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

এদিকে ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে নতুন করে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। শিশু আয়াত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুক্রবার রাতে ইপিজেড থানায় একটি মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। মামলায় আসামিকে দেখানো হয়েছে অজ্ঞাত। আয়াতের বাবা সোহেল রানা বাদী হয়ে মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল করিম।

ওসি আবদুল করিম শনিবার দুপুরে বলেন, আয়াত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। শিশু আয়াতের বাবা সোহেল রানা মামলাটির বাদী। মামলায় অজ্ঞাত আসামি দেখনো হয়েছে। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করবেন বলে জানান তিনি।

বিষয়ে শিশু আয়াতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। শিশু আয়াতের বাবা সোহেল রানা শারীরিকভাবে অসুস্থবোধ করায় কথা বলতে পারছিলেন না বলে জানালেন পরিবারের সদস্যরা।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা শনিবার বলেন, শিশু আয়াতকে অপহরণ এবং হত্যার ঘটনায় আমরা আসামি শনাক্ত করেছি। আবির আলী নামের একজনকে গ্রেফতার করেছি। এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। আমরা এখনো মরদেহের খণ্ডিত অংশগুলো উদ্ধারের কাজে আছি।

তবে থানায় রেকর্ড হওয়া মামলায় আসামি অজ্ঞাত দেখানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমরা আসামি শনাক্ত গ্রেফতার করেছি। মামলায় আসামিকে কেন অজ্ঞাত দেখনো হয়েছে, সেটা মামলা রেকর্ডকারি কর্মকর্তা বলতে পারবেন। গ্রেফতার আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়েছে।

শনাক্ত গ্রেফতারের পর দায়ের হওয়া মামলায় আসামি অজ্ঞাত দেখানোর বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন মানবাধীকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান। তিনি বলেন, শিশু আয়াত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সারাদেশের মানুষের মনে আঁচড় কেটেছে। যেহেতু আসামি শনাক্ত গ্রেফতারের পর থানায় মামলা হয়েছে। সেহেতু এজাহারে আসামি অজ্ঞাত দেখানোর কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে আসামিরা হয়তো প্রভাবশালী হতে পারেন। আবার এজাহারে আসামি অজ্ঞাত থাকলে মামলার ট্রায়ালে অপরাধীরা সুযোগ নিতে পারেন। এখন কেন আসামি অজ্ঞাত করা হয়েছে, সে বিষয়ে থানার ওসিকে কারণ দর্শানো উচিৎ।

তিনি বলেন, এখন যেহেতু মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছেন, তাদের উচিৎ গ্রেফতার করা আসামিকে ওই মামলায় দ্রুত গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ব্যবস্থা করা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আইনজীবী বলেন, ধরনের স্পর্শকাতর হত্যা মামলা এজাহারের আগে নিশ্চিতভাবে ভিকটিমের পরিবারকে থানার পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই থানায় এজাহার তৈরি করা হয়। টাইপ করা এজাহার থানার ওসি পরিপূর্ণভাবে পড়েন, কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) করার নির্দেশনা দেন। শিশু আয়াত হত্যাকাণ্ডের মামলাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে গ্রেফতার হওয়া মূল আসামিকে অজ্ঞাত দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আসামির সঙ্গে অন্য কোনো সহযোগী থাকলে তা অজ্ঞাত দেখাতে পারেন।

অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা রেকর্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির বন্দর জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, আমি সকাল থেকে মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম। মামলাটির এজাহার দেখার সুযোগ হয়নি। আসামি অজ্ঞাত রাখার বিষয়ে কোনো রিজন (যুক্তিযুক্ত কারণ) থাকতে পারে।

 

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর