রাজনীতি ৩০ নভেম্বর, ২০২২ ০২:০৫

সোহরাওয়ার্দী নাকি পল্টন? ১০ ডিসেম্বর নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত কয়েকদিন ধরেই রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছে ১০ ডিসেম্বর। দিন ঢাকায় ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করবে বিএনপি। আর সমাবেশ তারা করতে চায় নয়াপল্টনে। এতে তারা ১০ লাখ লোকের জমায়েত করতে চায়। তবে সরকার নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দিতে নারাজ, সরকার চায় বিএনপি সমাবেশ করুক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

বিএনপির সমাবেশের আগের দিন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। তবে সোহরাওয়ার্দীতে ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলনের যে তারিখ নির্ধারিত ছিল তা পরিবর্তন করে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- বিএনপিকে সহযোগিতা করতেই ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে।

১০ ডিসেম্বর ঘিরে সব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বিএনপির এই দিনের সমাবেশের ভেন্যু। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে জনভোগান্তি এড়িয়ে বিএনপি যেন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ। বিএনপির সমাবেশের সুবিধা বিবেচনায় ডিসেম্বরের পরিবর্তে সংগঠনটির সম্মেলন হবে ডিসেম্বর। সম্মেলনের পরপরই ভেঙে ফেলা হবে মঞ্চ। বিএনপির সমাবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

তবে বিএনপির নেতারা বলছে, উদ্যানে সমাবেশ করতে দেওয়ার পেছনে সরকারের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। তারা নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চায়। ফলে দিন যতই এগুচ্ছে, ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে অনড় দলটির শীর্ষ নেতারা।

এরই মধ্যে ২৬ শর্তে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)

তবে গত ২৮ নভেম্বর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ হবে। সরকার কখনও অনুমতি দেয়, কখনও দেয় না- এমন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, অনেক সময় অনুমতি দিলেও আক্রমণ করছে। আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বাধা-বিপত্তি দিলেও কর্মসূচি থাকবে। সমাবেশ ঘিরে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সরকার, পরিবহন ধর্মঘট ডাকে। যেই বিএনপির সমাবেশ শেষ তাদের ধর্মঘটও শেষ।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, বিএনপির সমাবেশের উদ্দেশ্যটাই খারাপ। উদ্দেশ্যটা হলো- স্থিতিশীল পরিবেশকে অস্থিতিশীল করা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, পেট্রল বোমা নিক্ষেপ, মানুষ পুড়িয়ে মারা। যে ঘটনাগুলো তারা ২০১৩, ১৪ ১৫ সালে ঘটিয়েছে। একইভাবে তারা আবার শুরু করার পাঁয়তারা করছে। তাদের লক্ষ্য তো দেশের মানুষের উন্নতি, অগ্রগতি সমৃদ্ধি না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে যে লড়াই সেটা তো এদের (বিএনপি) লক্ষ্য না। এদের লক্ষ্য হলো দেশের মানুষের শান্তি দূর করে আতঙ্কিত করা, ভয়-ভীতি দেখানো, উল্টো পথে ক্ষমতায় যাওয়া।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপিকে সহযোগিতা করা তাদের জনসমাবেশ ভালো জায়গায় করার জন্য ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ, আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) চান বিএনপি জনসমাবেশ ভালোভাবে করুক।

নভেম্বর বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

তিনি আরও বলেন, তাদের (বিএনপি) গণসমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার জন্য বলা হয়েছে, ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা ইজতেমা (তুরাগ) মাঠে করতে পারে। এখানে প্রায় ৫০ লাখ লোকের জমায়েত হয়। তারা পূর্বাচলের বাণিজ্য মেলার মাঠে নিতে পারে। সেখানে ২০ লাখ লোক এনে দেখাতে পারে যে জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য হলে সেখানে ২০ লাখ লোক এনে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে পারে।

১০ ডিসেম্বর ঘিরে আওয়ামী লীগ নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি না দিলেও রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ড থানা আওয়ামী লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতীম সহযোগী সংগঠনগুলোকে সক্রিয় থাকার নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপির গণসমাবেশের আশপাশে নেতাকর্মীদের অবস্থান না করতেও বলেছেন দলের হাইকমান্ড।

গত ২৮ নভেম্বর দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশে বাধা দেওয়া হবে না। গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।

বিএনপিকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনারা উসকানি দেবেন না। উসকানি দিলে কিন্তু খবর আছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা মাঠ ছেড়ে দিয়ে সতর্ক পাহারায় থাকবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি বলে আমরা তাদের সমাবেশে বাধা দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগের সমাবেশ দিয়েছি ডিসেম্বর। নেত্রী বললেন দরকার নেই। তারা সমাবেশ করুক। আমরা ছাত্রলীগের সমাবেশ তারিখে এগিয়ে এনেছি। তবে এটি বিএনপির আন্দোলনের ফসল নয়, এটি শেখ হাসিনার উদারতা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখল ইসলাম আলমগীর কুমিল্লার গণসমাবেশে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নয়াপল্টনেই হবে। ১০ ডিসেম্বরে ঢাকার গণসমাবেশে তারা নাকি আমাদের পূর্বাচলে পাঠাবে, তারপর বললেন ইজতেমা ময়দানে। এখন আরেকটু এগিয়ে এলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমরা বলি, আরেকটু এগিয়ে আসুন, তা ছাড়া উপায় নেই। এগিয়ে আসতেই হবে। নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়। সেখানে দেশের যেকোনো রাজনৈতিক দল নিজেদের সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে পারে। শান্তিপূর্ণভাবে কোনো দল সেখানে সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। তাদের দাবি, শহরের যে কোনো স্থানে বড় সমাবেশ হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়। দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। সেই বিবেচনায় সব দলের উচিত উদ্যানে সভা-সমাবেশ করা। খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ কেন্দ্র করে দলটির কার্যালয়ে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হয়।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার। জনগণের নির্বাচিত সরকার এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এখানে গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন আছে। যে কোনো রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করবেই, বাক স্বাধীনতা আছে। যে ক্ষেত্রে বিএনপিও স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার রাখে। সেই অধিকারকে সরকার সংরক্ষণ করে। তাদের (বিএনপি) যদি প্রকাশ্যে কথা বলতে হয় তাহলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা বলতে পারে। নয়াপল্টন ছোট জায়গা, ময়দানও না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা মানেই তাদের একটি দুরভিসন্ধি আছে, নিশ্চয়ই কোনো মতলবি ভাবনা আছে। তারা যদি মনে করে যে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে না করে গায়ের জোরে যেখানে ইচ্ছা সেখানে সমাবেশ করবে, এটা একটা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, সাংবিধানিক সরকার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কোনো দ্বিধা করবে না।

১০ ডিসেম্বরের আগে ডিসেম্বর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন, ডিসেম্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সম্মেলন, ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ উত্তর শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের বন পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকা শহরে কোনো পার্টি বা কোনো সংগঠন যদি সমাবেশের জন্য জায়গা চায় সেটা ডিএমপি অনুমোদন দেয়। সিটি করপোরেশনেরও অনুমতির দরকার হয়। কারণ, সিটি করপোরেশনের জায়গা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ যার জায়গা ব্যবহার করবে তার অনুমতি দরকার, আবার প্রশাসনিক অনুমতি দরকার। তারা (বিএনপি) যে তিনটি জায়গার নাম বলেছে তার মধ্যে থেকে একটি জায়গা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আমরা কোনো দিন তাদের কাছে বরাদ্দ চেয়ে বরাদ্দ পাইনি। বরং ২১ আগস্ট তারা আমাদের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩, ১৪ ১৫ সালে তারা (বিএনপি) সমাবেশ করে বের হয়েই মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, বাস ভাংচুর করেছে। বিএনপি কৌশলগত কারণে এখন এটা করছে না। কিন্তু ১০ তারিখ করবে না এমন না। যদি করে, আওয়ামী লীগ সহযোগী সংগঠন ঢাকা শহরে সতর্ক অবস্থানে থাকবে। জনগণের জানমালের ক্ষতি করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে প্রশাসনকে সহযোগীতা করতে প্রস্তুত থাকব।

গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সম্মেলন করার মাধ্যমে বিএনপি প্রায় দুই মাসব্যাপী তাদের কর্মসূচি শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর সিলেটে সমাবেশ করেছে বিএনপি। এই বিভাগীয় সম্মেলনের অংশ হিসেবেই ঢাকার সমাবেশ হবে বলে জানাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর