সম্পাদকীয় ২৯ জুলাই, ২০১৯ ০৮:২০

শিল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষির আধুনিকায়ন ঘটাতে হবে

ড. মোহাম্মাদ দুলাল মিয়া।। 

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের বিভিন্ন খাতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কৃষক ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছেন না। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। তবে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এ বক্তব্যের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, কৃষি ব্যতীত অন্যান্য খাতে শ্রমের মূল্য বেশি, তাই শ্রমিক কৃষির বদলে অন্যান্য খাতে কাজ করতে আগ্রহী। দ্বিতীয়ত, কৃষক বাজারমূল্যের নিরিখে শ্রমের দাম দিতে অপারগ হওয়ার কারণ হলো উৎপাদিত ফসল থেকে তাদের আয় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শ্রমিক নিয়োগে যথেষ্ট নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কৃষি থেকে অর্জিত আয় তুলনামূলক অন্যান্য খাতের চেয়ে কম, যার জন্য কৃষি ব্যতীত অন্যান্য খাত বেশি মজুরি দিয়ে শ্রম কিনে নিচ্ছে। যেহেতু কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগের মতো তুলনামূলক সুবিধা আর অবশিষ্ট নেই, কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রম অন্যান্য উচ্চমূল্যের কাজে স্থানান্তর হবে, মুক্তবাজার নীতিতে সেটাই স্বাভাবিক।

অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির অবদান কমে যাওয়া অকল্যাণকর নয়। বরং কৃষি খাতকে ভিত্তি করে শিল্পায়নের বৃদ্ধিই অর্থনীতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি খাতের প্রত্যক্ষ অবদান অনেক কম। কারণ শিল্প ও সেবা খাতই সেসব অর্থনীতির সিংহভাগ আয় ও উৎপাদনের জোগান দিয়ে থাকে। প্রখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে শিল্প-পরবর্তী যুগের যে পূর্বানুমান করেছিলেন, তাতে শিল্প আর সেবা খাতের প্রাধান্যকেই অর্থনীতির রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। বেলের মতে, শিল্প-পরবর্তী যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ক্ষমতাসীন এক নতুন অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব, সেবা খাতে শ্রমের অভাবনীয় আবির্ভাব আর প্রযুক্তির নজিরবিহীন উত্থান। শিল্প-পরবর্তী যুগে সেবা খাতই উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হবে, যা ধীরে ধীরে শিল্পের স্থান দখল করে নেবে।

উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি খাতের অবদান ছিল অপরিসীম—এ কথাও বেল স্পষ্ট করে বলেছেন। আজকের অনেক অনুন্নত দেশ কৃষিকে একরকম অবজ্ঞা করেই শিল্পায়নের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মৌলিক তত্ত্বের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ব্যত্যয়ের প্রধান কারণ হলো, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষির অবদান সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও বুঝতে না পারা। কৃষির অর্জন বা সাফল্যকে বাজার প্রবর্তিত নির্ণায়কের বাইরে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। যেমন দারিদ্র্য নিরসন, অর্থনীতির আন্তঃখাতগুলোর মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য, নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মতো সামাজিক বিষয়গুলোকে বাজার নির্ধারিত মাপকাঠি খুব কমই বিবেচনা করে।

শুধু আর্থিক দিক বিবেচনা করলে কৃষি একটি অলাভজনক খাত, যা পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে অপারগ। তাই বলে শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের কৃষি খাতকে পুরোপুরি বাজার অর্থনীতির হাতে ছেড়ে দেয়নি বা বিলুপ্ত করে দেয়নি। বরং বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য তাদের টিকিয়ে রেখেছে। যদিওবা সেসব দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবকাঠামো কৃষির জন্য ততটা সহায়ক নয়, যতটা স্বল্পোন্নত দেশের জন্য কার্যকর। এসব প্রণোদনার মধ্যে প্রধান হলো, কৃষক ও জমির মালিককে সরাসরি অর্থ প্রদান, সরকারি ক্রয়, উৎপাদিত পণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ, ফসল বীমা, দুর্যোগ বীমা, ক্রেডিট, বিপণন ও সেচ জলের ব্যবস্থায় ভর্তুকি প্রদান, কৃষিপণ্য রফতানিতে ভর্তুকি এবং কোটা বা শুল্কের মাধ্যমে আমদানি বাধা সৃষ্টি করা।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোর গ্রুপ অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সদস্য দেশগুলো ‘উৎপাদক সহায়ক স্কিম’-এর আওতায় প্রধান খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, চিনি ও পশুপণ্য থেকে রাজস্ব আয়ের প্রায় ৩১ শতাংশ ভর্তুকি দেয়। সর্বাধিক ভর্তুকি দেয়া হয় চাল উৎপাদনে, যা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। বিশ্বব্যাপী চালের ভর্তুকির একটি বড় অংশ যায় জাপান ও কোরিয়ার কৃষকদের সহায়তা প্রদানে। তবে সব ধরনের কৃষিপণ্য আমলে নিলে নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও আইসল্যান্ড সর্বাধিক ভর্তুকি দেয়, যার হার উৎপাদিত ফসলের মোট মূল্যের ৫৬-৭৫ শতাংশ। আর জাপান ও কোরিয়ায় এ হার ৬০-৬৫ শতাংশ। সর্বনিম্ন ভর্তুকির হার (৪ শতাংশেরও কম) অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভর্তুকির গড় হার উৎপাদিত পণ্যমূল্যের প্রায় ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকার যদিও কৃষিবান্ধব, কৃষিতে বরাদ্দ ও ভর্তুকির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তার ওপর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও আইএমএফের মতো খবরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপে কৃষিতে রাষ্ট্রের দেয়া সুবিধাদি প্রতি বছরই কমে আসছে, যদিও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির অবদান বাংলাদেশে এখনো অপরিসীম। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোকের গ্রামে বসবাস, যেখানে জীবন ও জীবিকার প্রধান উপায় হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কৃষি। ১৯৭২ সালে জিডিপির ৬০ শতাংশ ছিল কৃষির অবদান, যা কমে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ শতাংশ। জিডিপির অর্ধেকের বেশি (প্রায় ৫৬ শতাংশ) আসে সেবা খাত থেকে। বাকি ২৮ শতাংশ হলো শিল্প খাতের অবদান।

তবে এ পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে যথেষ্ট নয়। মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশই কৃষি খাতে জড়িত। যদিও কৃষিতে শ্রমিকপ্রতি গড় মূল্য সংযোজনের হার শিল্প ও সেবা খাতের চেয়ে কম। এ কথা মনে রাখতে হবে যে দেশের অদক্ষ শ্রমিকের সিংহভাগই কৃষিতে নিয়োজিত। এ শতাব্দীর শুরুর দশকে কৃষিতে মাথাপিছু মূল্য সংযোজনের (ভ্যালু অ্যাডেড) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা ২০১২-১৬ মেয়াদে কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। লক্ষণীয় যে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কৃষি প্রবৃদ্ধির হার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সমান বা কখনো কখনো বেশি ছিল। ২০০৫ সালের পর অবশ্য কৃষি প্রবৃদ্ধির হার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সমতা বজায় রাখতে পারেনি, তবে গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনে কৃষির অবদান তখনো ছিল অনস্বীকার্য। ২০০০ সালে মোট গ্রামীণ জনসংখ্যার ৫২ দশমিক ৩ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, যা ২০১৬ সালে অর্ধেকে (২৬ দশমিক ৪ শতাংশ) নেমে আসে। ঠিক একই সময়ে শহরে দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ২ ও ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে দারিদ্র্য হ্রাসের হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি ছিল, যাতে কৃষি খাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির নাজুক অবস্থার জন্য কৃষিবান্ধব নীতির অভাব অনেকাংশে দায়ী। একটি দেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হলো কৃষিনির্ভর কর্মকাণ্ড থেকে শিল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তর। তবে কৃষি বাদ দিয়ে এ রূপান্তর বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি—যার অধিকাংশই অদক্ষ—কৃষিতে জড়িত। এ বিরাট জনসংখ্যার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো না গেলে শিল্পপণ্যের চাহিদা বাড়বে না আর শিল্পের প্রসারও ঘটবে না। তাই শ্রমিকের মজুরির দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অধিকন্তু এসব অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণীকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করা না গেলে শিল্পে তাদের সংস্থান করা অসম্ভব। যতদিন সেটা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন কৃষিই হবে অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র। তাই কৃষি খাতকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।

তাছাড়া কৃষিকে শিল্পের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে, যাতে কৃষির বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়, আবার শিল্পের উৎপাদিত পণ্য কৃষিকাজে নিয়োগ করা যায়। এজন্য দরকার সমন্বিত নীতি, যার প্রধান হবে কৃষিকে আধুনিকীকরণ। এর নিমিত্তে কৃষিঋণ বাড়ানোসহ সুষ্ঠু বিতরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষিঋণ বিতরণ প্রতি বছর ক্রমে কমে আসছে। ২০০২ সালে কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৫ শতাংশে নেমে আসে। শুধু তা-ই নয়, কৃষিঋণের সিংহভাগই বিতরণ হয় বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের একটা নির্দিষ্ট অংশ কৃষি খাতে বিতরণের সরকারি বিধি রয়েছে। কিন্তু কৃষিঋণ বিতরণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোনো আগ্রহ নেই। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নির্ধারিত এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণের কোটা পূরণ করে থাকে। ২০১৪ সালে এনজিওর মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৮ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আবার এনজিওগুলো তাদের ইচ্ছামতো ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে, যা সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হয়। এনজিওগুলো থেকে কৃষক ঋণ নিতে অনিচ্ছুক হলেও পুঁজির অভাবে উচ্চ সুদহারে ঋণ নিয়ে থাকে। এ ঋণের ফাঁদ থেকে তারা সহজে বের হতে পারে না। তাই কৃষিঋণের কার্যকারিতা এখন প্রশ্নের মুখে।

সুষ্ঠু ঋণ বিতরণের বাধা দূরীকরণসহ কৃষিতে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ বাড়ানো নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড) কৃষিবীজ ব্যবহারে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামো কৃষি বিকাশে সহায়ক। তদুপরি একটি কার্যকর গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যম হিসেবে ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষির অবদান অপরিসীম। তাই বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য কৃষিকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না, বরং কৃষির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমেই কৃষিনির্ভর থেকে আধুনিক শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর সম্ভব।

 

ড. মোহাম্মাদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

ফিন্যান্স ও অর্থনীতি বিভাগ, নিজুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান