জাতীয় ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০১:৫৪

গণপরিবহনে ই-টিকেটিং : যাহা লাউ তাহাই কদু 

তানজিলুর রহমান: মিরপুর এলাকার বাসিন্দা মিশু অফিসে যাতায়াতের জন্য শিকড় ও বিকল্প পরিবহনে নিয়মিত চলাচল করেন। এক সময়ে ভাড়া নিয়ে হেলপারের সাথে কথা কাটাকাটি, ভাড়া নিযে বচসা ছিল নিয়মিত চিত্র। তবে ই-টিকেটিং চালুর পর থেকে পরে এই দুই বাসের ভাড়া কমেছে। তিনি জানান, বিপত্তি হয়ে দাড়িয়েছে হেলপারের টিকেট দিতে উদাসীনতা। অনেক সময় কনডাক্টর ইচ্ছা করে বাসের দরজা থেকে ভেতরে আসেন না। নামার সময় তাড়াহুড়ো করে টাকা রেখে দেন, কিন্তু টিকিট দেন না।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে মিশু বলেন, ‘শুধু ভাড়াই কমেছে, কিন্তু বাসে সেই আগের বিশৃঙ্খলা রয়েই গেছে। যাত্রীদের কপালে লাউ কদু সমানই থাকলো। 

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বাসে ই-টিকেটিং চালু করে। এর আওতায় চলাচল করা রুটে প্রথমে কাউন্টারে টিকিটের ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী সময়ে কাউন্টার উঠিয়ে বাসে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হয়, তবে টিকিটের গায়ে দূরত্ব লেখা না থাকায় ন্যায্য ভাড়া নেয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে অনেক যাত্রীর।

রাজধানীতে ই-টিকেটিং চালুর উদ্দেশ্য ছিল দূরত্ব অনুযায়ী বাস ভাড়া নিশ্চিত, নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে যাত্রী ওঠানামা এবং এক বাসের সঙ্গে আরেকটির রেষারেষি বন্ধ করা। ই-টিকেটিংয়ের আওতাধীন বিভিন্ন রুটে বাস ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য কিছুটা কমেছে, তবে বাকি দুই সমস্যা থেকেই গেছে।

কাউন্টার উঠিয়ে দেয়ার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ জানায়, কাউন্টার থেকে পাওয়া টাকা ব্যানার মালিকরা বাসমালিকদের ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেন না। তাদের দুর্নীতির কারণে বাসমালিকরা লাভ পেতেন না। তাই বাসের মধ্যে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়।

রাজধানীতে ৯৬টি বাস রুটের মধ্যে ৪৬টিতে চলছে ই-টিকেটিং। চলতি মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের শুরুতে আরও ১৭ রুটকে ই-টিকেটিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে বাসমালিক সমিতি।

ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ঢাকার ৯৬ রুটকে ই-টিকেটিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

ই-টিকেটিংয়ের আওতায় চলাচল করা বেশ কয়েকটি রুটে ঘুরে দেখা যায়, যাত্রীদের ই-টিকিট দিতে অনীহা কনডাক্টরদের। অনেক যাত্রীদের মধ্যেও উদাসীনতা আছে টিকিট নিয়ে। আবার অনেক যাত্রীকে চেয়ে চেয়ে টিকিট নিতে হয়েছে।

একাধিক যাত্রীর অভিযোগ, না চাইলে কনডাক্টররা টিকিট দেন না। বাসের রেষারেষি রয়েই গেছে। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। এমনকি চলন্ত রাস্তার মাঝখানে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী তোলা হয়।

কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে উত্তরা রুটে চলাচল করা প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহনেও একই চিত্র দেখা যায়। এ রুটে চলাচলকারী ইয়াসিন মোল্লা বলেন, প্রথম থেকেই এই রুটে ই-টিকেটিং চালু হয়। প্রথম দিকে যখন কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠতাম, তখন একটা শৃঙ্খলা ছিল। পরে ই-টিকিট বাসের ভেতরে কাটা শুরু হলে সেই আগের মতোই রেষারেষি শুরু হয়।

তিনি বলেন, ‘এখন তো ড্রাইভারের সঙ্গে চিল্লাপাল্লা করতে হয় নিয়মিত। তারা বাস থামিয়ে মিনিটের পর মিনিট বসে থাকে। যখন একই রুটে পেছনে আরেকটা বাস আসে, তখন শুরু হয় রেষারেষি।

‘মাঝে মাঝে এক বাসের চালক আরেক বাসকে ধাক্কাও দেয়। যে কারণে ই-টিকেটিং চালু করা, সেটা ফলপ্রসূ হয়নি।’

এই রেষারেষির কারণ অবশ্য বাসের মালিকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। অনেক রুটের বাসমালিক চুরি ঠেকাতে এখন চুক্তিতে গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহনের অন্তত সাতজন বাসমালিকের সঙ্গে কথা হয়। এই দুই পরিবহনের বাস চলে চুক্তিতে। এ ছাড়া অন্য রুটের অনেক বাসই চলে চুক্তিতে।

তাদের একজন বলেন, ‘যখন কাউন্টারে ই-টিকিট দেয়া হতো, তখন ব্যানার মালিকরা দুর্নীতি করে টাকা মেরে দিত। পরে বাসের ভেতরে টিকিট দেয়া শুরু হলে কনডাক্টর ভাড়ার টাকা নিয়ে টিকিট দিত না। আর টিকিট না দিলে মেশিনে টাকার পরিমাণ উঠত না। বেলা শেষে আমরা টাকা পেতাম না।

‘এখন প্রতিদিন আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে চুক্তিতে তাদের গাড়ি ভাড়া দিই। আমাদের বাসপ্রতি আড়াই হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, সেটা ড্রাইভার ও কনডাক্টরের লাভ।’

অর্থাৎ বাস মালিকদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, টিকিট নামে মাত্র। বাকি সব আগের নিয়মেই চলছে।

সব বাস চুক্তিতে না চললেও চুরি ও নৈরাজ্য রয়েই গেছে। বিকাশ পরিবহনের তিনটি বাসের মালিক মো. কাওসার বলেন, ‘আমাদের বাস চুক্তিতে চলে না। আমাদের কোম্পানি থেকে বলা আছে সবাইকে টিকিট দিতে হবে, তবে তারা মাঝে মাঝে টিকিট দেয় না, এটা আমরা জানি। কয়েক দিন ই-টিকেটিং চালু হয়েছে। আশা করছি কয়েক দিন গেলে ঝামেলা দূর হবে।’

যাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের দায়িত্ব নিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিদিন দেড় শ টাকা মেশিন ভাড়া দিই। এটা তো আর এমনি এমনি দেব না।’

ভাড়ার বিষয়টা কিছুটা সমাধান হলেও বাকি দুই বিষয়ে এখনও বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে বলে স্বীকার করে নেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘আগে যাত্রীদের থেকে অধিক ভাড়া আদায় করা হতো। ই-টিকেটিং চালু করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাড়ার নৈরাজ্য ঠেকানো। শতভাগ ভাড়ার নৈরাজ্য ঠেকানো না গেলেও ম্যাক্সিমাম নৈরাজ্য বন্ধ হয়েছে।’

বাসের রেষারেষি এখনও আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনও যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে। এই ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ৯৭ রুটে ই-টিকেটিংয়ের আওতায় আনার কাজ শেষ হবে। পরবর্তী সময়ে এই দুই বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করব। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া লক্কড়ঝক্কড় গাড়িগুলো চলাচল বন্ধ করব।’

কিছু কিছু রুটে চুক্তিতে বাস চলছে স্বীকার করে তিনি যাত্রীদের টিকিট নেয়ার বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

এসব বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণের যে শর্ত আছে, সেই শর্তে না চলে যদি বাস চুক্তিতে চলে, তাহলে পরিবহনের শৃঙ্খলা, রেষারেষি এবং ভাড়ার নৈরাজ্য কোনোভাবেই বন্ধ হবে না। তার আগে চালকের স্বচ্ছ নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে হবে।

‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সঠিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যেন তৃতীয় পক্ষের হাতে টাকা না যায়। ই-টিকেটিং তার অন্যতম একটা হাতিয়ার ছিল।’

তিনি বলেন, ‘গণপরিবহনে যদি নগদ লেনদেন বন্ধ না থাকে, ভাড়ার নৈরাজ্য কমবে না। দেশ উন্নত হচ্ছে, কিন্তু পরিবহন খাত উন্নত হচ্ছে না। ভাড়া আদায়ের পরে মালিকের পকেটে পৌঁছাবে কি না, এটা নিয়ে যদি চিন্তা করা লাগে, তাহলে র‍্যাপিড পাসের প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবহনে নগদ লেনদেন বন্ধ করা গেলে এ খাতের মানোন্নয়ন হবে।’

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর