অপরাধ ও দুর্নীতি ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০২:১৭

পার্বত্য অঞ্চলে জঙ্গি প্রশিক্ষণ

কেএনএফের ছত্রছায়ায় ডালপালা ছড়ায় জামাতুল আনসারের?

তানজিলুর রহমান: পার্বত্য অঞ্চলে গত কয়েকদিনের আলোচিত বিষয় জঙ্গি সংগঠন জামায়তুল আনসারের আস্তানায় অভিযান। প্রশ্ন জাগছে নতুন গড়ে উঠা এ সংগঠনটি কাদের ছত্রছায়ায় পার্বত্য অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে। তবে কেএনএফের তত্ত্বাবধানে তাদের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণের ভিডিও চিত্র বের হওয়ার পর নতুন জঙ্গি সংগঠনটি আবার আলোচনায় এসেছে এবং অনেক প্রশ্নের রহস্যজটও খুলে দিয়েছে। একই সঙ্গে ভিন্নধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আল-কায়েদা মতাদর্শী একটি উগ্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সম্পর্ক কীভাবে হলো, একে অন্যকে মেনে নিল কীভাবে; সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।

জানা গেছে, কেএনএফের সদস্যরা মূলত বম জাতিগোষ্ঠীর। জামাতুল আনসারের নেতারা বমদের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী হন মূলত বিশ্বস্ততার কারণে। তাদের আশ্রয়ে থাকা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিষয়ে ইসলামের ইতিহাসের একটা উদাহরণ সামনে এনে জঙ্গিনেতারা এর ব্যাখ্যা তৈরি করেন। সেটা হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তের পঞ্চম বছর একদল মুসলমান আবিসিনিয়ায় (বর্তমানে তা ইথিওপিয়ার অন্তর্গত) হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হজরত উসমান (রা.) ছিলেন। এটাকে ইসলামের প্রথম হিজরত বলা হয়। আর তখন আবিসিনিয়ার খ্রিষ্টান রাজা নাজ্জাসি মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বমরা যেহেতু খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, তাই এদের কাছে আশ্রয় নেওয়াকে জায়েজ বলে আখ্যা দেন জঙ্গিনেতারা।

কিন্তু আল-কায়েদা মতাদর্শী ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কেএনএফ কেন আশ্রয় দিল সে উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এ ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়ের চেয়ে কেএনএফের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জনবল বা শক্তি বৃদ্ধি। গত বছরের শুরুতে আলোচনায় আসা কেএনএফ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) তাদের মধ্যে একাধিকবার সংঘাতও হয়েছে।

পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিরাপদ আস্তানা গড়ে তোলাটা ছিল জামাতুল আনসারের কৌশলগত লক্ষ্য। আর পার্বত্য অঞ্চলের মত এমন জায়গায় কারো সহযোগিতা ছাড়া এ পা আগানো সম্ভব ছিল না এটা তারা বেশ ভালো রকম ভাবেই জানতো। তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে জন্য তারা পাহাড়ের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। ২০২১ সালে দুই সংগঠনের মধ্যে লিখিত চুক্তি হয়।

কেএনএফের প্রধান নাথাম বম মনে করেছেন, ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিলে তারাও কেএনএফের সঙ্গে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়বে। এরই মধ্যে গত বছরের জুনে এক সংঘর্ষে কেএনএফের পক্ষে লড়তে গিয়ে জামাতুল আনসারের এক সদস্য মোহাম্মদ আবদুর রহমান ওরফে জহির (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নোয়াখালীর যুবক জহিরের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় যাওয়া নিজামউদ্দিন ওরফে হিরণ সম্প্রতি গ্রেপ্তার হন। তার কাছ থেকে জহিরের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কেএনএফ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব তথ্য জানতে পারে।

জঙ্গিদের যাঁরাই পাহাড়ে গেছেন, প্রত্যেককে একটি করে ছদ্মনাম দিয়েছে কেএনএফ। সেটা বমদের নামের আদলে। ওই নামেই সেখানে তাঁদের ডাকা হতো। যেমন: প্রশিক্ষণের ভিডিওতে দুর্ধর্ষ যে শিব্বির আহমদকে দেখা গেছে, তাঁর ছদ্মনাম কারছে মিলন তালুকদের নাম দেওয়া হয় লামজল ইমরানের নাম দেওয়া হয় সাইতল রকম তিন ব্যাচে যে ৫৫ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, প্রত্যেকের একটি করে বম নাম রয়েছে। এটাও পাহাড়ের প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াইয়ে জঙ্গিদের ব্যবহারের কৌশলের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রশিক্ষণের জন্য কেএনএফের সঙ্গে জামাতুল আনসারের লিখিত চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, জামাতুল আনসার আশ্রয় প্রশিক্ষণ বাবদ কেএনএফকে প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দিত। ছাড়া কেএনএফের যে ১৫০ জন সদস্য রয়েছে, তাঁদের খাওয়ার খরচ দিত। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণ শুরু, চুক্তি ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

বিষয়ে তদন্ত গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, জামাতুল আনসারের প্রধান উপদেষ্টা শামীন মাহফুজের মাধ্যমে নাথান বমের সঙ্গে জামাতুল আনসারের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়। শামীন মাহফুজ ওরফে ম্যানরিং মরং ২০১৪ সালে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। তখন পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল, বান্দরবানের থানচিতে জমি নিয়ে সেখানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে শামীন নতুন জঙ্গি সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সঙ্গে যুক্ত হন।

কেএনএফের ক্যাম্পে পর্যন্ত তিন ব্যাচে জামাতুল আনসারের ৫৫ জন প্রশিক্ষণ নেন। তাদের প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধানে ছিলেন কেএনএফের প্রধান নাথান বম, তাদের সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার ভাংচুং লিয়ান বম, মিডিয়া শাখাপ্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই মাওয়াইয়া কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল চির চির ময়। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের গ্রেপ্তার কেএনএফ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে র‍্যাব সূত্র জানিয়েছে।

কেএনএফের ক্যাম্পে তাদের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ নিলেও পরে তাদের কাছ থেকে জামাতুল আনসার কিছু অস্ত্র কিনেছেও। এর মধ্যে একে-২২ রাইফেল শটগান রয়েছে ১৫টি। ছাড়া কিছু গাদাবন্দুকও কিনেছে। যার যার অস্ত্রের গায়ে সাংকেতিক নম্বর বা চিহ্ন দেওয়া আছে যাতে চেনা যায়। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ভিডিওতেও সেটা দেখা গেছে।

ছাড়া প্রশিক্ষণে তারা যে ফৌজি পোশাক পরেছে, সেটা জঙ্গিদের তৈরি। তাদের দলে দুজন দরজি আছে। একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি মো. দিদার, বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণে বলে জানা গেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পাহাড়ের আস্তানায় কেএনএফ জামাতুল আনসারের জঙ্গিরা একসঙ্গে যেমন থেকেছে, খাওয়াদাওয়াও একসঙ্গে করেছে।

দুই ভিন্ন গোষ্ঠীর এই সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব হলো জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মশিউর রহমান গতকাল বুধবার বলেন, এই জঙ্গিগোষ্ঠী দুর্গম পাহাড়ে একটা নিরাপদ আস্তানা গড়ে তুলতে চেয়েছিল। জন্য তারা পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফকে বেছে নিয়েছে। কেএনএফের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর, তাঁরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাঁদের মিত্র হিসেবে বেছে নেওয়ার পক্ষে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে মহানবী (সা.)এর আমলে মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় একদল মুসলমানের হিজরত করার উদাহরণ সামনে আনে জামাতুল আনসার। তবে তাদের যুক্তি এখানে টেকে না। কারণ, তখন মক্কায় যে পরিস্থিতিতে মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় বা মদিনায় হিজরত করেছেন, এখন সেই পরিস্থিতি নেই।

 

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর