অর্থ ও বাণিজ্য ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৩:৩১

অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পণ্যের দাম, আসন্ন রমজান নিয়ে শঙ্কা

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সব ধরনের পণ্যের দাম নিম্নমুখী। দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সোয়া ১৯ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য (চাল-গম) মজুত আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের মজুতও সন্তোষজনক। আমদানি অব্যাহত রাখতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেক পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই, যদি না ব্যবসায়ীরা কোন কারসাজি করে। তবে ডলারসংকটে রোজায় অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি (ঋণপত্র) খোলার সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা।

রমজান মাস এলেই কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। রোজার দুই মাস বাকি থাকলেও এই মাসটিকে ঘিরে প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম এরই মধ্যে চড়তে শুরু করেছে। সাধারণত চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কম থাকে। কিন্তু বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকার পরও দাম বাড়ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা . বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ নির্দেশনা ডলার সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোক্তা অধিকার আইন প্রয়োগ করে এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। না হলে মজুত কারবার বন্ধ হবে না।

দেশে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কমেছে। এই মুহূর্তে কোনো পণ্যের দাম কমা ছাড়া বাড়ার কোনো কারণ নেই। তার পরও যদি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে অথবা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দেবে। তিনি এও বলেন, রোজায় পণ্য আমদানিতে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে আশ্বাস দিচ্ছে তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন গোলাম রহমান।

অবশ্য কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রোজার মাসে কেউ যেন ভোক্তাদের জিম্মি করতে না পারে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকতে বলেছেন মন্ত্রী। গতকাল বুধবার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের একটি সেশনে মতবিনিময়ে তিনি নির্দেশনা দেন।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সম্মেলনে মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে ৩০ সেকেন্ড বলেছি রোজায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে বলেছি, রমজান মাস সামনে রেখে কেউ যাতে সুযোগ নিতে না পারে। আপনারা সরকারের হাত। আপনারা খেয়াল রাখবেন কেউ যাতে সুযোগ না নেয়। শক্ত ব্যবস্থা নেবেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রোজায় পেঁয়াজের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। এবার রোজায় এই পণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এদিক দিয়ে স্বস্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব পণ্যের দামই এখন অনেক কমেছে। অনেক পণ্যের দাম করোনার আগের অবস্থানে চলে এসেছে। সরকার কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে এবার রোজায় পণ্যমূল্য বাড়বে না।

চিনি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বার্ষিক চিনির মোট চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে আখ থেকে ৩০-৩৫ হাজার টন চিনি উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য অপরিশোধিত চিনি প্রায় ২০ লাখ টন আমদানি করা হয়।

সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ তিন লাখ টনে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের চিনি আমদানি করা হয়েছে। কাস্টমসের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে দেশে মোট লাখ ৩৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে।

সয়াবিন তেল

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা আড়াই থাকে তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় দুই লাখ টন। অর্থাৎ ১৮ লাখ টন ভোজ্যতলে আমদানি করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে, ২০২১ সালের একই সময়ে যা ছিল ১১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আমদানি বেড়েছে ৪০ দশমিক শতাংশ।

পেঁয়াজ

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রোজার মাসে চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ টন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকালে ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়। দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় ছয় থেকে সাত লাখ টন। ২০২১ সালের মে-অক্টোবরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল লাখ ৪০ হাজার ১২৫ টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছে লাখ ১৯ হাজার ১০৩ টন। ফলে আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ।

ছোলা

সরকারি হিসাবে দেশে বছরে ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। এর মধ্যে রোজার মাসেই প্রয়োজন হয় ৮০ হাজার টন। মাত্র ছয় হাজার টন স্থানীয় উৎপাদনের বিপরীতে আমদানি করতে হয় আরও প্রায় এক লাখ টন। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে সাড়ে ৫৩ হাজার টন।

খেজুর

দেশে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজান মাসেই চাহিদা ২৫ হাজার টন। ফলে প্রতিবছরই এর প্রভাব পড়ে দামে। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৩ টন।

মসুর ডাল

বছরে মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। রমজানে এই চাহিদা ৭০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় লাখ হাজার টন। আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয় লাখ ৫০ হাজার টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে মুসর ডাল উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ টন। আমদানির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে লাখ ৯৯ হাজার টন।

সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে: গভর্নর

বর্তমানে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা আগামী দু-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত সোমবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) নবনির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এমন কথা বলেছেন।

গভর্নর বলেন, রজমান মাসে কোনো পণ্যের যাতে কোনো ধরনের ঘাটতি না হয়, সে জন্য দুই মাস ধরেই ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা হচ্ছে। কারও এলসি খুলতে সমস্যা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। আশা করছি, এবার রমজানে পণ্য আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না।

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর