অপরাধ ও দুর্নীতি ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০২:০৪

সাগর-রুনি হত্যা

‘৪৮ ঘণ্টা’ শেষ হয়নি ১১ বছরেও

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: ১১ বছরেও শনাক্ত হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার মেহেরুন রুনি হত্যার হত্যাকারীকে। মাস গড়িয়ে বছরের পর বছর কেটে গেলেও এখনওতদন্ত চলছেআরবিচার হবেতে সীমাবদ্ধ তদন্তকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা। অথচ ২০১২ সালে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডের পর সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তারা বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হবে।

কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার সেই আল্টিমেটাম শেষ হয়নি ১১ বছরেও। মাঝে কেটে গেছে ৯৬ হাজার ৩৬০ ঘণ্টারও বেশি সময়। এত সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৯৫ বার সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। কিন্তু এখনও প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এতে হতাশ সাগর-রুনির পরিবারসহ সাংবাদিক মহল।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। তখন বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সারোয়ার মেঘ। হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেছিলেন।

আদালতে শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখা সূত্র জানায়, মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ৯৫ বার তারিখ পেছানো হয়েছে। আগামী মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।

এত সময় পেরিয়ে গেলেও মামলার বিচারই শুরু করা যায়নি। এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বিভিন্ন সময় রাজপথে আন্দোলন চলমান রেখেছেন তাদের সহকর্মীরা।

শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) সময় সাংবাদিক নেতারা বলেন, ১১ বছর আগে সাগররুনিকে হত্যা করা হয়েছে। এই ১১ বছরে একই সরকার ক্ষমতায় আছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন পিছিয়েছে ৯৫ বার। আর কয়েকবার পর এটি সেঞ্চুরি পার করবে- যা খুবই লজ্জার। বিচার ব্যবস্থা তদন্তকারী সংস্থার প্রতি দিনের পর দিন আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। ১১ বছরেও যদি একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সাংবাদিকরা কোথায় যাবে? অতিদ্রুত এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন জড়িতদের বিচারের দাবিও জানানো হয় সমাবেশে।

ছাড়াও দ্রুত সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার ( ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নেতারা। স্মারকলিপি গ্রহণের পর সচিবালয়ে নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার প্রতিবেদন দ্রুত দিতে র‌্যাবকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বিচার তো আমরা করতে পারবো না, আমরা তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারবো। চেষ্টা করছি, অনেক বছর তো হয়ে গেছে। আমরাও চাই, রহস্য উন্মোচিত হোক। উদীয়মান দুই সাংবাদিক, যাদের অনেক প্রতিভা ছিল, তারা দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তারা আমাদের মধ্য থেকে চলে গেছেন। আমরাও চাই, কেন হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেটি উদঘাটন করতে।

মামলায় প্রথমে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) চার দিন পর চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবের কাঁধে দেওয়া হয়।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ১০ বছর ১০ মাস পার হলেও সংস্থাটি এখনও কোনও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি আদালতে। পেছাতে পেছাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৯৫ বার পেছাতে হয়েছে। সর্বশেষ জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। র‌্যাব প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল আলম প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মার্চ নতুন দিন ধার্য করেন।

এদিকে, মামলার পর রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আট জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার অপর আসামিরা হলেনবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন, পলাশ রুদ্র পাল আবু সাঈদ। এদের মধ্যে তানভীর পলাশ রুদ্র জামিনে থাকলেও অপর আসামিরা কারাগারে।

নিহত সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, ১১ বছর ধরে তদন্ত করছে। কিন্তু খুনিদের চিহ্নিত করতে পারেনি। কেন তাদের হত্যা করা হলো। কারা হত্যা করলো। এখনও জানতে পারিনি। এটা কী এতই কঠিন কাজ। নাকি খুনিদের গোপন রাখতে প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না। র‌্যাব অনেক ক্লুলেস-আলোচিত মামলার তদন্ত করতে পারলো। আর এটার করতে পারছে না কেন? তারা না পারলে বলে দিক পারবো না। আর হাইকোর্ট থেকেও একটা সময় বেধে দিক। যেন ওই সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তার আসামিদের নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের চিহ্নিত করার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। তাই সবারআইওয়াশকরতে পাহারাদার, রুনির বন্ধুসহ নির্দোষ ব্যক্তিদের ধরা হয়েছে। তারা আমার ছেলে-বউদের কেন হত্যা করবে? যদি হত্যা করে চার্জশিট দিক- কী কারণে তারা হত্যা করেছে। মূল আসামিরা শক্তিশালী বলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এদিকে, মামলার বাদী নিহত সাংবাদিক রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, হত্যার ১১ বছরেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারলো না। আসলে বিষয়ে সরকার আন্তরিক না। র‌্যাবেরও তদন্তে আগ্রহ নেই। নাটকের অংশ হিসেবে নির্দোষ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা যদি খুনি হয়, তাহলে প্রতিবেদন দিক কেন খুন করেছে, কীভাবে করেছে।

বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম বলেন, মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বসহকারে মামলার তদন্ত চলছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, তদন্ত দ্রুত শেষ করা উচিত। ন্যায় বিচার সবাই পেতে চাই। মামলায় যদি কোনও ক্লু না পাওয়া যায় সেভাবে প্রতিবেদন দিক। দীর্ঘদিন এভাবে পড়ে থাকলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, দীর্ঘ ১১ বছরেও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। প্রতি ধার্য তারিখে আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতেই হচ্ছে। আমরা আশা করছি, আলোচিত মামলার তদন্ত যেন দ্রুত শেষ হয়।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর