সারাদেশ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১২:৩৮

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস

 শতকোটির সার্ভার রুমে ঢুকে সফটওয়্যার হ্যাকের চেষ্টা

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অপারেশন ম্যানেজারের কক্ষে ঢুকে অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার হ্যাক করার চেষ্টার অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় করা মামলায় বলা হয়, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত করতেই এই যুবকেরা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ঢুকেছিলেন। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সন্দেহ, এর পেছনে বড় কোনো চক্রের হাত রয়েছে। ঘটনাটির কয়েক দিন পর কাস্টমসের অপারেশন ম্যানেজারসহ ২৮ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া দুই যুবক ছাড়াও এ ঘটনার সঙ্গে আরও যাঁরা জড়িত, তাঁদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আসামিদের কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, সে ব্যাপারেও পুলিশকে কিছু প্রশ্ন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

এর আগেও দেশের বিভিন্ন বন্দরে ব্যবহার করা অ্যাসাইকুডা নামে পরিচিত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সফটওয়্যারে ঢুকে শত শত কোটি টাকার পণ্য পাচারের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ৩৩টি মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

দুই যুবককে গ্রেপ্তারের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অপারেশন ম্যানেজারের কক্ষ থেকে দুই যুবককে আটকের ব্যাপারে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহসিন একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক দফা রিমান্ডে আনা হয়। আবারও তাঁদের রিমান্ডে আনা হবে।

বন্দর থানায় দায়ের করা এজাহারে বলা হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টা ২০ মিনিটের দিকে কাস্টম হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য দ্বীন ইসলাম দেখেন, অজ্ঞাতনামা দুই যুবক কাস্টম হাউসের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। তিনি তাঁদের পিছু নিয়ে দেখেন, ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে যুবকেরা কাস্টম হাউসের নিচতলায় উপকমিশনার নুরুন নাহার লিলির কক্ষে ঢুকে পড়েছেন। এরপর তিনি সেই কক্ষের দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। ততক্ষণে ১০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। তিনি দেখতে পান, যুবকদের একজন কম্পিউটারসহ বিভিন্ন নথি তন্নতন্ন করে খুঁজছেন। আরেকজন কাস্টম হাউসের ভেতরে সন্দেহজনকভাবে পায়চারি করছেন। তিনি যুবকদের কাছে গিয়ে তাঁদের পরিচয় জানতে চান এবং চ্যালেঞ্জ করেন। এরপর যুবকেরা কোনো কথা না বলে বের হয়ে বাইরে দাঁড় করানো মোটরসাইকেলে উঠে চলে যেতে থাকেন। এ সময় অন্য আনসার সদস্যরা দৌড়ে এসে মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে তাঁদের আটক করেন। পরে তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

আটক হওয়া যুবকেরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, তাঁদের একজনের নাম মো. মেহেদী হাসান ওরফে রায়হান (২৯), বাড়ি ঢাকার তেজগাঁওয়ের মণিপুরীপাড়ায়; অন্যজন ফেনী সদর এলাকার খায়েজ আহমেদ (২৯)। পুলিশ তাঁদের ব্যবহার করা মোটরসাইকেলটিও জব্দ করে।

আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে দুটি ঠিকানায় খোঁজ করে এই নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। তেজগাঁও থানা-পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে মেহেদী হাসান ওরফে রায়হানের মণিপুরীপাড়ায় ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তেজগাঁও থানা-পুলিশ ওই ঠিকানায় গিয়ে মেহেদী হাসান রায়হান নামের সঠিক ঠিকানা পায়নি। তবে আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে মণিপুরীপাড়ায় ওই নম্বরের বাড়ির সন্ধান মিলেছে। বাড়ির মালিক মনোয়ার ইসলাম সিবলী জানান, রায়হান নামের এক যুবক বাসাভাড়া নিয়ে ব্যাচেলর থাকতেন। তাঁর বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। কিছুদিন আগে তাঁরা বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহসিন এজাহারে আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। দিনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা। এই বন্দরে দিনে প্রায় সাত হাজার বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে শুল্কায়ন হয়। এসব কাজে ব্যবহার করা হয় ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস’ নামের একটি সফটওয়্যার। অপারেশন ম্যানেজার এই সফটওয়্যারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এ কারণে অপারেশন ম্যানেজারের কক্ষটি খুবই স্পর্শকাতর। তিনি অভিযোগ করেন, দুই যুবক তাঁর কক্ষে ঢুকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং রাজস্ব আয়কে বাধাগ্রস্ত করে জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এর সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা ছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জানতে চাইলে বন্দর থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, অনেক বড় ঘটনা। এই আসামিরা বড় কোনো পরিকল্পনা নিয়েই স্পর্শকাতর স্থানে ঢুকেছিলেন। তবে এখনো তাঁরা কোনো কিছু স্বীকার করেননি।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন জানান, কাস্টমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক করার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের তৎপরতা চালানো হয়েছে, যা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

এদিকে এ ঘটনার ৯ দিনের মাথায় ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে একযোগে ২৮ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এই বদলির তালিকায় অপারেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি কমিশনার নুরুন নাহার লিলিও রয়েছেন। যদিও কাস্টমসের উপকমিশনার ব্যারিস্টার মো. বদরুদ্দিন মুনসী বলেছেন, দুই যুবক গ্রেপ্তারের সঙ্গে ২৮ জনের বদলির কোনো সম্পর্ক নেই।

উল্লেখ্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্ভার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমসে অনুপ্রবেশ বা হ্যাকিংয়ের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সরকারি আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য পাচারে জড়িত সংঘবদ্ধ একটি চক্র তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই সার্ভারের অবৈধ ব্যবহার করেছিল। এ সময়ে চক্রটি শত শত কোটি টাকার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করে নিয়ে যায়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, চক্রটি এই সার্ভারে ২০১৬ সাল থেকে ৩ হাজার ৭৭৭ বার লগ ইন করে। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করেন চট্টগ্রাম কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ নিয়ে তদন্তে কমিটির পর কমিটি হয়েছে, মামলাও হয়েছে; কিন্তু চক্রের কিছুই হয়নি। তারা এখনো সক্রিয় রয়ে গেছে।

চট্টগ্রামের জুনিয়র চেম্বারের সাবেক সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ এলিট বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা খুবই উদ্বেগের। এ ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। এ কারণে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করাটা খুব জরুরি।’

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর