সারাদেশ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১২:৫০

অর্থ সংকটে আরসা, বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে ছুটছেন প্রবাসীদের কাছে

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া এক নেতার বিষয়ে তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এতে উঠে আসে, বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠীটি বিভিন্ন দেশে থাকা তাদের সদস্যদের একত্র করছে। উদ্দেশ্য- সেসব দেশে থাকা প্রবাসী রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করে অর্থের যোগান পাওয়া।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিশেষ নজরদারির দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কারণে আরসা ক্যাম্পের ভেতরে এবং বাইরের রোহিঙ্গাদের কাছে বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। জনপ্রিয় নেতা মুহিবুল্লা হত্যাকাণ্ডের পর আরসার প্রতি রোহিঙ্গাদের বিশ্বস্ততা আরও কমতে থাকে।

এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই রোহিঙ্গারা আরসাকে আর্থিক অনুদানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ইয়াবা বাণিজ্য, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নবি হুসেইন বাহিনীকে লোকবল সরবরাহ এসব খাত থেকেও আরসার আর আগের মতো আয় নেই বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র।

আরসার মূল লক্ষ্য আরাকানে স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি তাদের ছোট থেকে বড় সব নেতাকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠাচ্ছে। যাতে তারা ওইসব দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করে অর্থের চালান আনতে পারে। বাইরে যাওয়ার সময় এসব আরসা সদস্যরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং পরিচয়পত্র ব্যবাহার করছে।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি পাসপোর্টে ওমরা ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়ার পথে আরসা কমান্ডার মোহাম্মদ আসাদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ।

পুলিশ সূত্র বলছে, ৩২ বছর বয়সী আসাদুল্লাহর বাস ছিল কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ১২ নম্বর ক্যাম্পে। এ বছরের ৯ জানুয়ারি উখিয়া থানায় দায়ের হওয়া এক হত্যা মামলার আসামি সে।
আসাদুল্লাহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) বিশেষ অভিযানে নামে। এতে ভুয়া পাসপোর্ট ছাপায় নিয়োজিত চারজন এবং দুই রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভুয়া পাসপোর্ট ছাপা চক্রের চারজন হলো- মো. খসরু পারভেজ (৩৬), মো. তাসলিম (২৮), মো. ইসমাইল (২০) ও মো. ফারুক (২৭)। অভিযানে গ্রেপ্তার দুই রোহিঙ্গা হলো- মো. জাবের (২৫) ও রাজি আলম (২৭)।

সিএমপি ডিবি (উত্তর) জোনের ডেপুটি কমিশনার নিহাদ আদনান জানান, অভিযানে পাঁচটি ভুয়া বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং একটি জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়।

সৌদি আরবে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার হওয়া আসাদুল্লাহ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করেছিল। গত বছরের ২৭ নভেম্বর তার নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু হয়।
নগরীর পাঁচলাইশ আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে আবেদন করে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে এই আরসা নেতা। এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর তার নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ইস্যু হয়। ওই এনআইডিতে তার ঠিকানা ছিল চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা এলাকা। আসাদুল্লাহর নামে ইস্যু হওয়া ই-পাসপোর্টটির মেয়াদ ২০৩২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।

সিএমপি ডিবি উত্তর জোনের ডেপুটি কমিশনার নিহাদ আদনান জানান, একটি চক্র রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট সরবরাহ করে তাদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ভিসা এবং বিদেশ ভ্রমণের জন্য রোহিঙ্গাদের খরচ করতে হয় ৪-৫ লাখ টাকা।

এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের কেবল নাম ও ছবি দিলেই চলে। এছাড়া বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা এসবই জাল।
এই সিন্ডিকেটের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হয় চট্টগ্রামকে ঘিরে। আঙুলের ছাপের জন্য রোহিঙ্গা “আবেদনকারীদের” ঢাকায় আনা-নেওয়ার কাজটিও করে থাকে এই চক্রটি।

জানা গেছে, আসাদুল্লাহ আরসার আর্থিক বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্ব পালন করে আসছিল দীর্ঘদিন। ইয়াবা ব্যবসার মুনাফার একটি বড় অংশ সে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে আসছিল হুন্ডির মাধ্যমে।

রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানায়, পাচার করা এসব অর্থ নিয়ে অন্তর্কোন্দলের জেরে জরুরিভিত্তিতে সৌদি আরবে যাচ্ছিল আসাদুল্লাহ।

সূত্রগুলো আরও জানায়, কেবল আসাদুল্লাহই নয় বাংলাদেশি এনআইডি রয়েছে কুখ্যাত রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারী চিকুইন্যা এবং তার ভাই ইসমাইলের কাছেও।

স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির মহাসচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, এক রোহিঙ্গাকে জাল পাসপোর্ট নিতে সহায়তা করেছিলেন গ্রাম পুলিশের এক সদস্য।

চেয়ারম্যান বলেন, “আমাকে না জানিয়েই বিনা অনুমতিতে গ্রাম পুলিশ সদস্য নুরুল হোসেন তার জামাতা (রোহিঙ্গা) মোক্তার হোসেনকে নিজের ছেলে পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়পত্র তৈরি করে দেন। বিষয়টি জানার পর আমি দুই মাস আগে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করি।”

জানা গেছে, এই মোক্তার হোসেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ইয়ার মোহাম্মদের ছেলে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাচ্ছিল্যের সুরে অভিযুক্ত নুরুল বলেন, “অন্যরা এই কাজ করলে কোনো সমস্যা নেই, আর আমি করলেই বড় ইস্যু। আমার ইস্যু ছাড়াও দেশে আরও অনেক বিষয় আছে, সেগুলো দেখেন। আপনার যা খুশি করেন।”

রোহিঙ্গা সূত্র বলছে, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যূত হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশি জন্ম সনদ, এনআইডি, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র করিয়ে নেয়। এসব কাগজপত্র দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যায়।

এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অসৎ কর্মচারীরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক সনদ পেতে সহায়তা করেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে স্থানীয় মানুষ হুমকির মুখে পড়বে। এমন জঘণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তদন্ত না হলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।”

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর