সোশ্যাল মিডিয়া ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০৩:১৫

ডাকসু সভায় ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যা হলো

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সদস্য ডাকসু ।। 

আলোচ্যসূচী অনুযায়ী সাহিত্য সম্পাদক প্রস্তাব উত্থাপন করে, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক'। প্রস্তাবের উপর আলোচনা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় পক্ষ দুটি- একদিকে ছাত্রলীগের ২৩ জন, অপরদিকে নুর ও আকতার। নুর-আকতারের আলোচনায় এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কয়েকটি বিষয় আসে। সেগুলো হলো- সংবিধানে উল্লেখিত রাজনৈতিক দল করার স্বাধীনতা, ডাকসুর কাউকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার আছে কি না, জাতীয় পর্যায়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকতে পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পারবে না, পরিবেশ পরিষদে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকার পর নতুন করে আবার এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা। 

এর বিপরীতে ছাত্রলীগের রাকিবুল হাসান রাকিব, সাদ্দাম, শয়ন ও অর্নি ব্যাখ্যা প্রদান করে। ব্যাখ্যাগুলো ছিল- 

১. সংবিধানের সাথে এটি সাংঘর্ষিক হয় না। সংবিধানে উল্লেখিত দল করার স্বাধীনতা থাকলেও ২৮ নং অনুচ্ছেদে আছে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের ভিত্তিতে কোন বৈষম্য করা যাবে না, যা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে হয়। একইসাথে সংবিধানের চার মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আপহোল্ড রাখতে কোন অনুচ্ছেদই অন্তরায় হতে পারে না। 

২. ডাকসুর এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোন এখতিয়ারের প্রশ্ন আসতে পারে না। ডাকসু নির্বাচনের পূর্বে গঠনতন্ত্র সংশোধনী সভায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রশ্ন উঠলে তা নির্বাচিত ডাকসুর মাধ্যমে সমাধান করার সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু বর্তমানে ডাকসু রয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সংঘটিত প্রতিটি বিষয়েই যেহেতু ডাকসু কনসার্ন সেহেতু এখতিয়ারের প্রশ্ন উঠতে পারে না। একইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক যে গৌরবগাঁথা, বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতার মহান ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত সবকিছু বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কোনভাবেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিচালিত হতে দিতে পারি না। 

৩. জাতীয় পর্যায়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার কোন সম্পর্ক নেই। একইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকসু তথা ছাত্রসমাজ পথ দেখাবে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে তা। ডাকসু কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে আমরা জাতিকে এই বার্তা দিতে চাই যে, জাতীয় পর্যায়েও ধর্মভিত্তিক কোন রাজনৈতিক দল থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের মিনি পার্লামেন্ট ডাকসু যেমন আজ ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দ্বারপ্রান্তে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদও ডাকসুকে অনুসরণ করে অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। 

৪. পরিবেশ পরিষদে ধার্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নাই। সেখানে এরশাদের ছাত্রসমাজ ও ছাত্রশিবিরিকে নিষিদ্ধের কথা বলা আছে। কিন্তু এক ছাত্রশিবির মানেই ধর্মভিত্তিক সব ছাত্র সংগঠন বোঝায় না। পাশাপাশি পরিবেশ পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার ১৯৭৩ মোতাবেক বৈধ কিছু নয়। এটি আমাদের সামনে একটি নৈতিক মানদণ্ড। এই মানদণ্ডকে আরও বিস্তারিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার ১৯৭৩ স্বীকৃত ডাকসু কর্তৃক লিখিত ও আইনি কাঠামোয় আনতে হবে। পাশাপাশি ১১ মার্চ এর ডাকসু নির্বাচনে ইশা ছাত্র আন্দোলন ও এরশাদের ছাত্রসমাজের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ পরিষদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাই ডাকসুকে অবশ্যই আজ নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার পর সভাপতি প্রস্তাবটি পাশ করা নিয়ে সবার হ্যাঁ/না মতামত চান। নতুন করে কোন 'না' মত না আসায় এ প্রস্তাবের আলোকে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত ৩টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

১. ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করছে। 

২. ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এ সংক্রান্ত ধারা সংযুক্ত করে ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক কোন ছাত্র সংগঠনের কেউ যেন আগামীতে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে সে বিধান প্রণয়ন। 

৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পর্যায়েই কেউ যেন ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করতে না পারে সে লক্ষ্যে সিনেট-সিন্ডিকেট সব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কমিটিতে বিধি ও নির্দেশনা প্রণয়ন। 

এই ৩টি সিদ্ধান্তের প্রথমটি সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানানো হয়, ডাকসুর এ সিদ্ধান্তকে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি প্রদান করার। এবং তৃতীয় সিদ্ধান্তটির মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানানো হয় যে, শুধুমাত্র ছাত্ররাজনীতিই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন কমিউনিটি কোন পর্যায়েই যেন ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলতে না পারে সে সংক্রান্ত বিধি প্রণয়নের। 

ডাকসুর নির্বাহী সভার কার্যবিবরণীতে উপরে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ই উল্লেখ আছে। এখানে মনগড়া কিছু নেই, সভায় যা হয়েছে তাই। ভিপি নুর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বর্তমানে যে টালমাতাল অবস্থায় পড়েছে, তা মূলত তার 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' অবস্থা। ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, উগ্রপন্থী, জঙ্গীভাবাপন্ন গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় ডাকসুর ভিপি হওয়া নুর বর্তমানে নিজেই সেসব গোষ্ঠীর প্রধান মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। ভিপির অর্থের যোগানদাতাও এসব গোষ্ঠী। তারা সবাই আজ ভিপির উপর ভীষণ অখুশি, 'নুরের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ মিটিং এ কামডা করল ক্যামনে?' এ উত্তর নুরই দিবে। উত্তর দিতে নুর হিমশিম খেলে কিংবা একেকবার একেক রকম প্রলাপ বকলে সে দায় ভিপিকেই নিতে হবে, ডাকসু নিবে না।