আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পিটা লিমজারাট ঠিক অন্য সব থাই রাজনীতিবিদের মত নন। যে দেশে মন্ত্রীদের গড় বয়স ৬৫ আর যেখানে বয়সে বড়দের কথা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেয়াকে ঐতিহ্য হিসেবে মনে করা হয় – সেখানে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই তার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান এনে দিয়েছে তাকে।
থাইল্যান্ডে গত ৭৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হয়তো তিনিই হতে যাচ্ছেন। একটা লম্বা সময় থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসা রক্ষণশীল রাজনৈতিক ধারাকে হারিয়ে তার দল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি দেশটির পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি আসন পায় এবারের নির্বাচনে।
এখন জোট সরকার গঠন করা হবে কিনা, তা নিয়ে থাইল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ফেউ থাই পার্টির সাথে আলোচনা চলছে। ফেউ থাই পার্টি থাইল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আর ২০০১ সালের পর থেকে দেশটিতে হওয়া সব নির্বাচন তারাই জিতেছে।
১৪ই মে’র নির্বাচনের আগেও তারাই বিজয়ী হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল।
ফেউ থাই আর মুভ ফরোয়ার্ড, দুই পার্টিই নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে দাবি করে। এই দুই দলই ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছিল।
কিন্তু এই দুই দলের মধ্য মুভ ফেরায়ার্ড পার্টির তরুণ অ্যাক্টিভিস্টরা এবারের নির্বাচনে ফেউ থাই পার্টির অপেক্ষাকৃত বয়স্ক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভালোভাবেই পরাজিত করেছে।
নির্বাচনে তাদের প্রচারণা ছিল বেশ ভিন্নধর্মী ও সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক। ভোটারদের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল যে তারা অতীতের সবকিছু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে আসবে।
'অন্যরকম' হবার প্রতিশ্রুতি
আমার সাথে কথা দেয়ার সময় পিটা বলছিলেন, “আমি অন্যরকম। প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়ার জন্য বা পুরো বিষয়টা তাড়াতাড়ি সমাধান করার জন্য আমরা জোটে যাচ্ছি না। আমি জনগণের জন্য সরকারে যোগ দিয়েছি। পৃথিবী বদলে গেছে।”
“মানুষ আপনার কথা শুনবে, এটি নিশ্চিত করার জন্য আপনার মধ্যে পুরুষোচিত তেজ থাকতে হবে বা শক্তিশালী হতে হবে, তা নয়। আপনার যে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে তাও নয়।”
“আমার সবসময় নিখুঁতও হতে হবে না। আমি থাইল্যান্ডের আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই মোটরবাইক চালিয়ে, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাঘুরি করে জীবন কাটানো একজন ব্যক্তিও হয়ে থাকতে পারি।”
পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি
পিটা লিমজারাটের জন্ম থাইল্যান্ডের একটি সম্পদশালী পরিবারে।
তার ভাষ্যমতে, কৈশোরে তার স্কুলজীবন কেটেছে নিউজিল্যান্ডে, উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, পরিবারের ধানের তুষের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন এবং সবশেষ রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেছেন।
নিউজ্যালন্ডের জেসিন্ডা আডার্ন ও উরুগুয়ের হোসে ‘পেপে’ মুহিকার মত সাধারণ জীবনযাপন করা নেতাদের তিনি আদর্শ মনে করেন।
থাইল্যান্ডের নির্বাচনি ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ছিল এবারে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নির্বাচনি ইশতেহারে।
তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকা ৩০০ প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ডে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের বিয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের আইন বাতিল, ব্যবসায় বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য বাতিল করা ও একবিংশ শতাব্দির চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা নীতি পরিবর্তন করা।
সেনাবাহিনীর তৈরি সংবিধান বাতিল করারও পরিকল্পনা রয়েছে পার্টির। তারা সেনাবাহিনীর বেশ কিছু ব্যবসা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে চায়।
“সেনা অভ্যুত্থানের চক্র শেষ করার সময় হয়েছে। রাজনীতিতে থাকা যে দুর্নীতি ধরণের অভ্যুত্থানের রাস্তা তৈরি করে দেয়, সেই দুর্নীতিকেও বিদায় জানানোর সময় হয়েছে”, বলছিলেন পিটা।
বিতর্ক তৈরি করেছে যে প্রতিশ্রুতি
তবে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে লেস ম্যাজেস্তে আইন সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে।
থাইল্যান্ডের রাজ পরিবারকে অবমাননা করা হলে অভিযুক্তকে লম্বা সময় কারাগারে থাকতে হয় এই আইনের অধীনে।
পাশাপাশি রাজ পরিবার ও থাই জনগণের মধ্যে আলোচনা শুরু করারও পরিকল্পনা আছে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে।
তবে আগের সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকারের ২৫০ জন সিনেটরের অনেকেই বলছেন যে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করবেন তারা। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোটাভুটিতে এই সিনেটরদের অনেকেরই যোগ দেয়ার কথা।
পিটা বলছিলেন, “যুগের মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয় এখন আমাদের রাজতন্ত্র নিয়ে কথা বলার পরিপক্কতা ও সহনশীলতা এসেছে।”
“এমনকি রক্ষণশীলরাও বোঝেন যে একবিংশ শতকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ভূমিকা কি হতে পারে।”
“আমরা এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের ভোট পেয়েছি। আর তারা বোঝেন যে এই এজেন্ডাটি আমরা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছি।”
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নেতারা বিশ্বাস করেন যে তাদের জোট পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৫০০ আসনের ৩১২ আসন রয়েছে এখন জোটের দখলে। পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে তাদের এখনো ৬৪ জন সিনেটরের সমর্থন প্রয়োজন।
তবে সিনেটের ভেতরের সূত্রমতে, মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি যদি লেস ম্যাজেস্তে আইন সংশোধন করতে বদ্ধপরিকর থাকে, তাহলে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নেতারা বিশ্বাস করেন যে তাদের জোট পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।
পিটা লিমজারাট নতুন পররাষ্ট্র নীতিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত এক দশকে থাইল্যান্ডের সেনা সমর্থিত সরকারগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খূব একটা নজর দেয়নি। আগের প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুথ চান-ওচা’রও পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে খুব একটা মাথাব্যাথা ছিল না।
তবে পিটা বলছেন, “আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সাথে আমাদের অবশ্যই আরো বেশি সম্পর্ক রাখা উচিৎ।”
“আমাদের নতুন করে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। আমাদের আরো বেশি আলোচনায় অংশ নিতে হবে, আর নিয়মতান্ত্রিক বিশ্ব নীতির সাথে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে।”
“অর্থনীতি,
“বায়ু দূষণ, সারের দাম থেকে শুরু করে আমাদের নিজেদের অনেক সমস্যাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পৃক্ত, এই বিষয়টি বোঝা প্রয়োজন।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, তার সরকার থাইল্যান্ডের আসিয়ান (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স) মিত্রদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের সমাধান করতে চায় এবং থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে যুদ্ধ কবলিত নাগরিকদের জন্য আরো বেশি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে চায়।
যেসব চ্যালেঞ্জ পিটার সামনে
তবে এই তরুণ প্রধানমন্ত্রীর সামনে এখন কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সন্দেহপ্রবণ সিনেট সদস্যরা ছাড়াও জোটের শরিক ফেউ থাই পার্টির সাথেও ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে তাদের। ফেউ থাই পার্টি নির্বাচনে তাদের চেয়ে মাত্র ১০টি আসন কম পেয়েছে। তাদের দলে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের সংখ্যাও মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির চেয়ে বেশি।
ফেউ থাই পার্টি এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পদ এবং পার্লামেন্টের স্পিকারের পদ চেয়েছে। পিটাও মনে করে তার অনেক আইন পাস করার জন্য স্পিকারের পদ তার দলের হাতে থাকা উচিৎ।
তার দল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির সাংসদদের অধিকাংশই এবারই প্রথম এমপি হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স আবার ৩৫-এর কম এবং এ কারণে তারা আইন অনুযায়ী মন্ত্রীও হতে পারবেন না। কয়েকজনের বিরুদ্ধে আবার পুরনো রাজনৈতিক মামলাও রয়েছে।
ফেউ থাই পার্টি এমন কোনো জোটও যোগ দিতে পারে যেখানে সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যরা থাকতে পারেন।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি অবশ্য এই ধরণের কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে।
পিটা লিমটারাজের বিশ্বাস, দুই দলের কেউই বর্তমান জোট থেকে বের হতে চাইবে না। তার ভাষায়, এটি তাদের ‘স্বপ্নের জোট’ আর জোট থেকে বের হলে ফেউ থাই পার্টির ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে।
তবে রাজনীতি নিয়ে টানাপোড়েন থাকলেও পিটা লিমটারাজ সহজ-স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছেন সবকিছু।
তিন আমাকে বলছিলেন, “আমি অন্য থাই রাজনীতিবিদদের মত হতে চাই না যারা সত্তর বা আশি বছর বয়সে এসেও পদের জন্য যুদ্ধ করে যায়।”
“আমি হয়তো আরো দশ বছর এই দায়িত্বে থাকতে চাই। এরপর হয়তো অন্যকিছু করবো।” সূত্র: বিবিসি
আমাদের কাগজ/টিআর