নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকার পতনে এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনের লড়াইয়ে নেমে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে সব স্তরে প্রায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ছে দলটি। এতে নেতাকর্মীরা কিছুটা দিগ্ভ্রান্ত। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিপর্যয় এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও গণগ্রেপ্তার অভিযানে এমন নেতৃত্ব সংকটে পড়েছিল বিএনপি। এবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে মাঠে সক্রিয় সাতজনের মধ্যে মহাসচিবসহ তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতাই হত্যা ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। সক্রিয় অন্য চারজনও গ্রেপ্তার এড়াতে এখন আত্মগোপনে। দলের চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ তিনজন সাজাপ্রাপ্ত, বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয় চারজন, আইনি জটিলতায় ভারতে আটকা একজন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন চার সদস্য। এ পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে দলটিতে।
যদিও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এবার কিছুটা কৌশল বদল করেছে দীর্ঘ ১৭ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকে হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপি। দলটির হাইকমান্ড বলছেন, কারাগারের বাইরে যে একজন নেতা বা কর্মী থাকবেন, তিনিই দলের নেতৃত্ব দেবেন। সব নেতাকে গ্রেপ্তার করেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্দলীয় সরকারের দাবির আন্দোলন থেকে বিএনপিকে আর পিছু হটানো যাবে না। গণতন্ত্রকামী দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের গণআন্দোলনের পক্ষে থাকবেন বলে আশা করছে দলটি।
বিএনপি ও সমমনা দলের সূত্র জানায়, শুধু বিএনপি নেতারা নন, গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলের নেতারাও সামনের কঠিন পরিস্থিতিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা এবং বাস্তবায়নের ঘোষণা দিতে পারবেন। গ্রেপ্তার এড়িয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি সফল করতে ভার্চুয়ালি জরুরি বৈঠক ও যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। এমনকি বিএনপির প্রতিটি স্তরের কমিটির শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হলেও ক্রমান্বয়ে পরবর্তী পদে থাকা নেতারাই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পদায়িত হয়ে সংকটকালীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেবেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল শুক্রবার মোবাইল ফোনে বলেন, আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করছেন– সরকারের দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য এই মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার-আটকে নাকি বিএনপি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে! বিষয়টি হচ্ছে, রাতারাতি যেমন একটি দলে নেতৃত্ব তৈরি করা যায় না, তেমনি রাতারাতি একটি দলকে নেতৃত্বশূন্যও করা যায় না। বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। তার ওপরে রয়েছে মধ্য সারির ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনায় শক্ত মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি। কাজেই অন্যায় জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। যাকেই যেখানে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে জনগণের মধ্য থেকেই। বাস্তব কথা হচ্ছে, এবার যতদিন না এ দেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে, ততদিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে।
অবশ্য ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিপর্যয় এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও গণগ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব সংকটে পড়েছিল বিএনপি। সে সময়ের মামলার রায়েই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। অন্য নেতারা পুরোনো সেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সে অবস্থায় নতুন করে মামলার আসামি হয়েছেন। এমনকি ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দলে সংস্কার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর ভাঙন চেষ্টার বিভেদের রেখা এখনও মুছতে পারেনি বিএনপি।
তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন বহুল আলোচিত সংস্কার প্রস্তাবকে সমর্থনকারীরা পৃথক বিএনপি গঠনে সফল হয়নি। ওই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা বেশ কয়েকজন নেতাকে এখনও বিএনপিতে সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি বিএনপির সাবেক নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)’ নামে ‘কিংস পার্টি’তে যোগদানের আশঙ্কায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন দলটির হাইকমান্ড। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধিত দল দুটিতে বিএনপি ক্ষুব্ধ ও কোণঠাসা নেতারা ‘নানা লোভনীয় প্রস্তাবে’ সাড়া দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। অবশ্য এ ধরনের আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপি নামে দুটি দল গঠিত হয়। যদিও এখন অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন দলটি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আছে।
মামলার জালে স্থায়ী সদস্যরা
২০০৭ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত পুলিশ হত্যা, নাশকতা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মামলার জালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান), মহাসচিবসহ ১৯ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটি। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩৬টি। এরই মধ্যে দুটি মামলায় ১০ ও ৭ বছর করে মোট ১৭ বছর সাজা হয়েছে তাঁর। তিনি অসুস্থতাজনিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজাভোগ থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ৫০টি। এর মধ্যে চারটি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে তাঁর।
চলমান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন স্থায়ী কমিটির ৭ নেতা। তাদের তিনজন বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলা ৯৮টি ও নতুন ৪টি মামলা। মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে পুরোনো ৪৮ ও নতুন ৪টি মামলা এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে পুরোনো ৬টি এবং নতুন ৩ মামলা দেওয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন বাকি চারজন। তাদের মধ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে পুরোনো ৩৬টি ও নতুন ৩টি মামলা দেওয়া হয়। নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা হয়েছে। ড. আব্দুল মঈন খানের বিরুদ্ধে একটি এবং সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা হয়েছে।
এ ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আগ থেকে বিদেশে পলাতক ইকবাল হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে। আর অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় ভারতে দীর্ঘদিন সাজা খেটে বর্তমানে জামিন পেলেও আইনি জটিলতায় সেখানে অবস্থান করছেন সালাউদ্দিন আহমেদ।
অসুস্থতার কারণে চারজন নিষ্ক্রিয় থাকলেও শুধু ভার্চুয়াল মিটিংয়ে যুক্ত হন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া দলীয় কার্যক্রমে বিরত রয়েছেন। মারা গেছেন কমিটির চার সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ এবং এম কে আনোয়ার।
সর্বস্তরেই নেতৃত্ব সংকটের শঙ্কা
পুরোনো ও নতুন হত্যা, নাশকতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় শুধু বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরাই নন, ৮৫টি সাংগঠনিক জেলাসহ প্রায় সর্বস্তরেই প্রকাশ্যে নেতৃত্ব সংকট বিরাজ করছে। সরকারের সাঁড়াশি অভিযানে রাজপথে সক্রিয় থাকা দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিভিন্ন সম্পাদক, সহসম্পাদক, নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব নেতাই গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মহানগর ও জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেসব মহানগর ও জেলায় সিনিয়র সহসভাপতিকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, প্রথম যুগ্ম সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ককে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এবং আহ্বায়ক কমিটির সিনিয়র সদস্যকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়েছে। দলের দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে পুলিশের হিসাবে ঢাকায় প্রায় আড়াই হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৬৬টি। বিএনপির হিসাবে সারাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭ হাজার ৫৩৭ জন। আসামি করা হয়েছে ৩৭ হাজার ১৮৫ জনকে। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৫৭ জন। দলটির হিসাবে নিহত হয়েছেন ৯ জন।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছাড়াও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের প্রধান জহিরউদ্দিন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারাও গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি।
এদিকে বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় তালাবদ্ধ। দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ আত্মগোপনে থেকে ভার্চুয়ালি প্রেস ব্রিফিং করছেন। আজ থেকে শুরু হওয়া নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণপত্র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের গেটের ভেতর চেয়ারের ওপর রেখে গেছেন কমিশনের বার্তাবাহক। গতকাল পর্যন্ত চেয়ারের ওপরই পড়ে রয়েছে ওই চিঠি।