আন্তর্জাতিক ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০৭:০৭

ক্রিকেটের নায়ক থেকে ১০ বছরের জেল : একজন ইমরান খানের উত্থান-পতন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং নিজ দেশ পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তী থেকে রাজনৈতিক নেতা বনে যাওয়া ইমরান খান বর্তমানে কারাগারে আছেন। রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁসের মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মঙ্গলবার এই রায় দিয়েছেন পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত।

৭১ বছর বয়সী ইমরান খানের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বিভিন্ন আদালতে অন্তত কয়েক ডজন মামলার কার্যক্রম চলছে । ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর টানা ২২ বছর মাঠের রাজনীতিতে ব্যাপক সক্রিয়তা শেষে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনাসফ (পিটিআই); সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইমরান খান। কিন্তু মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে, ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল পার্লামেন্টের বিরোধী সদস্যদের ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। তার পর বিভিন্ন সময়ে আদালতে দায়ের হয়েছে মামলাগুলো।

আর ৮ দিন পর, ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে পাকিস্তানে। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসসহ বিভিন্ন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইমরানের পক্ষে সেই নির্বাচনে প্রার্থিতা করা সম্ভব হচ্ছে না। ইমরানসহ দলের শীর্ষ নেতারা কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে থাকায় সীমাহীন চাপে রয়েছে তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফও।

নির্বাচনে পিটিআইয়ের প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক ক্রিকেট বেট ব্যবহারের ওপর আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দলটির অনেক নেতা-কর্মী কারাগারে আছেন এবং যারা প্রার্থিতা করছেন, তাদেরকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে।

অথচ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বলছে, পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল পিটিআই এবং ইমরান খান দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইমরান খান এবং তার পিটিআইয়ের যে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে পাকিস্তানে, অন্য কোনো নেতা বা দল তার ধারে কাছেও নেই।

গত বছর এক জরিপে জানা গিয়েছিল, কেবল পাকিস্তানে নয়— পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শীর্ষ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ইমরান খান। আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় গত ৯ মে যখন ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সে সময় নজিরবিহীন বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল পাকিস্তানে এবং দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেনানিবাস ও সামরিক বাহিনীর স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

২০২৩ সালে জুন মাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছিলেন, নিজের গোটা রাজনীতি ও ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কখনও কোনো অবৈধ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল না তার। আরও বলেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে এবং তার রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে চ্যুতির জন্যও সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেছিলেন তিনি।

তবে পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া এবং বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।

প্রসঙ্গত, গত ৬৫ বছর ধরে পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে রয়েছে সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন সময় কখনও প্রকাশ্যে, কখনও বা পর্দার আড়ালে থেকে এই বাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব রেখে চলেছে এবং এখনও দেশটির বৃহত্তম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

প্লেবয় থেকে রাজনৈতিক নেতা

১৯৫২ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরে একটি সম্ভ্রান্ত পশতু পরিবারে জন্ম নেন ইমরান খান। ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি-শওকত খানম দম্পতির একমাত্র পুত্র সন্তান তিনি। ইমরান খান ছাড়াও চার কন্যা রয়েছে এই দম্পতির।

পাকিস্তানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তিনি। ভর্তি হন বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।

তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের উত্থানও এই সময়ই। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে খেলতেন তিনি। সেই সুবাদে পাকিস্তানের জাতীয় দলেও নিয়মিত হন এবং সেই ধারাবাহিকতায় একসময় জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কও বনে যান।

গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ও শেষের দিকে লন্ডনে তিনি পরিচিত ছিলেন প্লেবয় হিসেবে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যের ধনকুবের জেমস গোল্ডস্মিথের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন তিনি। সুলাইমান ইসা ও কাসিম নামে এই দম্পতির দুই সন্তানও রয়েছেন।

২০০৪ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর টিভি সাংবাদিক রেহাম খানকে বিয়ে করলেও অল্প সময়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। ইমরানের বর্তমান স্ত্রীর নাম বুশরা বিবি।

১৯৯৬ সালে পিটিআই প্রতিষ্ঠার পর থেকে পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। তবে রাজনীতিতে তার প্রকৃত উত্থান শুরু হয় ২০১১ সাল থেকে। ওই বছর দুর্নীতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি, শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন শুরু করেন তিনি, যা দেশটির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। মূলত পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও উন্নয়নকামী তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয়তার ওপর ভর করেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হন ইমরান।

পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করেছে মাত্র একবার, ১৯৯২ সালে। সেই ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছিলেন ইমরান খান। গত বছর রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানকে একটি কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন তিনি।

কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত দুই বছরের ঘটনাপ্রবাহ তার সেই স্বপ্নকে যে গভীর অন্ধকারে ফেলেছে, তা থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এমনকি শিগগিরই তিনি রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন— এমন সম্ভাবনাও শূন্য।