অর্থ ও বাণিজ্য ১৩ অক্টোবর, ২০১৯ ০৮:০৮

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে

ডেস্ক রিপোর্ট।। 

জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি  (২০১৯-২০) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে তিনগুণ।  চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) ৩ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই ও আগস্ট) বিক্রি হয়েছিল ৯ হাজার ৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থবছরের প্রথম মাসের মতো দ্বিতীয় মাসেও কমে এসেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। আগের বছরের আগস্ট মাসের চেয়ে চলতি বছরের আগস্টে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগস্ট মাসে ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের বছরের (২০১৮) আগস্ট মাসে ৪ হাজার ২১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, যা ২০১৯ সালের আগস্টের চেয়ে ১ হাজর ৮১৬ কোটি টাকা বেশি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, মূলত চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদে ওপর উৎসে কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ায় পরেই এর প্রভাব পড়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে। এই প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই কমে আসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। গত জুলাই মাসে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগের বছরের (২০১৮) জুলাই মাসে ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র কেনা অনেকেই কমিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে আগের মতো কিনতেও পারছেন না। এর প্রধান কারণ উৎসে কর বেড়ে যাওয়া। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপও বড় ভূমিকা রেখেছে।’
প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমাতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয় সরকার। চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া, এক লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই ব্যক্তির একাধিক জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ঠেকাতেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। এছাড়া গ্রাহকদের জুলাই ও আগস্ট মাসের কেনা সব ধরণের সঞ্চয়পত্রে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হয়েছে।

এদিকে, গত অর্থবছরে সবমিলিয়ে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে সুদ-আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদ-আসল পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে খরচ হয় ২০ হাজার ২৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের খরচ হয়েছে ২২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকায় ঠেকে। সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই মূলত, বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই দুইভাবে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। এর একটি হচ্ছে বৈদেশিক সহায়তা, অন্যটি অভ্যন্তরীণ উৎস। অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এই খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি।

যদিও সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।
বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের চালু করা চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এগুলো হলো—পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এগুলোর গড় সুদের হার ১১ শতাংশের বেশি।

জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ বিনিয়োগকারী এটি পছন্দ করেন। সঞ্চয়-বিনিয়োগকারীদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পছন্দ হচ্ছে তিন মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্র।