রাজনীতি ২৮ নভেম্বর, ২০২৪ ০৩:২০

সাংবিধানিক কাঠামো সংস্কারে যেসব প্রস্তাব দিল জাতীয় পার্ট

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়ার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত করাসহ সাংবিধানিক কাঠামোতে সংস্কারের লক্ষ্যে সংশোধনীর বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাজধানীর বনানীতে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবিধান সংস্কারবিষয়ক জাতীয় পার্টির প্রস্তাবনা উপস্থাপনায় পার্টির মহাসচিবসহ প্রেসিডিয়াম সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী যদি দুজন ভিন্ন ব্যক্তি হতেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংসদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ভারসাম্য থাকতে পারত। ঐতিহ্যগতভাবে, এটি কখনও ঘটেনি। এখন পর্যন্ত, যখনই সুযোগ আসে, দলীয় প্রধানই প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। সেই প্রেক্ষাপটে, সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রথম সুপারিশ হলো- সরকারি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়ার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত করা। এখানে রাজনৈতিক দল বলতে সংবিধানে অনুচ্ছেদ-১৫২ (১) এ রাজনৈতিক দলকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেটাই বোঝানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা প্রস্তাব করতে চাই যে সংসদ সদস্যদের সংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোটদানের সুযোগ থাকবে। তবে, তারা সেটা করতে পারবেন যখন দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যাবে এবং কমপক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে সেভাবে পরিবর্তন করার প্রস্তাব করছি। এর ফলে দরকষাকষি কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে এবং সংসদ অধিকতর কার্যকর ও সরকারের স্থায়িত্ব কিছুটা হলেও নিশ্চিত হবে। দলত্যাগ বিরোধী বিধি-বিধানের উপরের পরামর্শের জন্য, 'দশম তফসিল, অনুচ্ছেদ ৩', ভারতের সংবিধান অনুসরণ করা হয়েছে।

সংস্কার প্রস্তাবে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দেখায়, যদি একজন ব্যক্তি দীর্ঘ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তবে সেই ব্যক্তি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা দেখান এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। এভাবে, বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধানে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা সর্বোচ্চ দুইবার শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জন্যও একই পরামর্শ দিতে চাই অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি সে পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না। এই বিধানটি আমাদের সংশোধিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

আরও সংস্কার প্রস্তাবে যাওয়ার আগে আমরা পরামর্শ দিতে চাই উল্লেখ করে তিনি যে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানগুলো পুনরায় চালু করা হবে।

সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি, সর্বসম্মত প্রার্থী বিবেচিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। ১৫তম সংশোধনী বাতিল করার পরে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮ (খ)-তে, সে অনুযায়ী পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে ৭(ক) অনুচ্ছেদটি বাদ হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭(ক) যুক্তিসংগত বলে বিবেচিত হয় না। সংবিধানের ৭ (খ) অনুচ্ছেদটিও বাতিল হবে। এটির ফলে বর্তমানে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৮ অনুযায়ী সংগঠন করার মৌলিক অধিকারের উপর সরকারের জনবিরোধী বিধিনিষেধ থাকবে না।

রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং সংসদ সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে হওয়া উচিত। এর ফলে রাষ্ট্রপতি মোটামুটি সর্বসম্মত প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাষ্ট্রপতি নিয়োগের জন্য তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুচ্ছেদ ৪৮(ক) সংশোধন করতে হবে।

রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের জন্য সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান প্রবর্তন করে স্থায়ীত্বের ঝুঁকি হ্রাস করার প্রস্তাব করছি। সেই অনুযায়ী সংবিধানের ৫২ নং ধারা সংশোধন করতে হবে।

তারা বলেন, আমরা অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) সংশোধনের নিম্নরূপ প্রস্তাব করতে চাই, 'এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৬ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে, নির্ধারিত পদ্ধতি, যদি থাকে অথবা নিজের বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী কার্য করিবেন, যদি কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি না থাকে।

দুইজন ডেপুটি স্পিকারের বিধান থাকা উচিত, একজনকে অবশ্যই বিরোধী দল থেকে মনোনীত/নির্বাচিত হতে হবে। অনুচ্ছেদ-৭৪ (১) অনুযায়ী দুই ডেপুটি স্পিকারকে সরকারি দল এবং বিরোধী দল থেকে একজন করে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করছি।

সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ১৯৭২ সালের মূল বিধান পুনরুদ্ধারকারী যোড়শ সংশোধনী এরইমধ্যে আপিল বিভাগের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ, ১০৯ এর অধীন অর্পিত কার্যাবলী পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করার জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় থাকবে। একই সচিবালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের দাপ্তরিক কাজও পরিচালনা করা যেতে পারে। সংবিধানে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

অনুচ্ছেদ-১১৬ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১০৯ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটি অপ্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং বাদ দেওয়া যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৫ (২) (গ) এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে।

সংসদ সদস্যদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু মহিলা প্রার্থীদের মাধ্যমে পঞ্চাশটি (৫০) আসন পূরণ করা হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(৩) এ বর্ণিত বিষয়টি অক্ষত রেখে আমরা প্রস্তাব করতে চাই, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই তাদের মোট প্রার্থীর কমপক্ষে দশ শতাংশ মহিলা প্রার্থী সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে। এই মহিলা প্রার্থীরা অন্যান্য দলের পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শুধু মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে প্রার্থী নির্বাচন করার সময়, দলের যে মহিলা প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচনে লড়েছিলেন কিন্তু জিততে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।

জাতীয় পার্টি বলছে, আমরা প্রস্তাব করছি, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। তবে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সদস্যদের মনোনয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একটি 'অনুসন্ধান কমিটি' গঠন করবেন। অনুসন্ধান কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ সদস্যকে অবশ্যই বিরোধী দল থেকে মনোনীত করতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাদের নিয়োগ দেবেন।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২৬ এ, নির্বাচনের সময় কোনো কর্মকর্তা ইসির নির্দেশনা না মানলে নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে। এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।

কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকবে না। রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগগুলো চূড়ান্ত করবেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন ইত্যাদির মতো অন্যান্য সব সাংবিধানিক সংস্থার জন্য এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নিম্নোক্ত ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন- বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছে জাতীয় পার্টি।