অর্থ ও বাণিজ্য ১২ নভেম্বর, ২০১৯ ০৬:৫৯

পেঁয়াজের পর এবার ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার

ডেস্ক রিপোর্ট।। 

প্রায় দুই মাস ধরে বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম। এই সময়ে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে চালের দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমন মৌসুমের আগে শেষ সময়ে মিলে ধানের সরবরাহ কমেছে। এ যুক্তিতে চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। গত দুই দিনে কেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে চালের দাম বাড়লেও পরে তা কমে যায়। গত মাসে চালের দাম গড়ে ৫ শতাংশ কমেছে। এর ফলে অক্টোবর মাসে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল চালের দাম। এখন আবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে একসঙ্গে চালের দাম বেড়েছে। ধানের দাম বাড়তি থাকায় চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মিনিকেট চালের দাম। মিল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দর বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায় একই সুরে কথা বলছেন। হঠাৎ করে দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা মৌসুম শেষ হওয়ায় দাম বাড়ছে বলে যুক্তি দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ধানের সরবরাহ কমে আসায় চালের দাম বেড়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মনে করেন, মিলের কারসাজির কারণেই এবার দাম বাড়ছে। কেননা গত বোরো মৌসুমের ধানের মজুদ এখনই শেষ হওয়ার কথা নয়। এ ধান থেকেই সবচেয়ে বেশি বিক্রীত মিনিকেট চাল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু আমন মৌসুমের আগেই ধানের ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। তবে এই দাম বৃদ্ধির সুফল এবার আমন মৌসুমে কৃষকরা পেলে ভালো হবে।

বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, সরকার আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়ায় ধানের দাম বেড়েছে। এর ফলে বাজারে চালের দাম বাড়ছে। যদিও এখন মাঠে আমন ধান রয়েছে। এই ধান কেবল পাকতে শুরু করেছে। চালের এই দাম বৃদ্ধিতে কৃষকরা ধানের ভালো দাম পাবেন। মৌসুমের আগে দাম বৃদ্ধিতে কৃষকরা আরও উৎসাহিত হবেন। তিনি বলেন, মিলগুলোতে ধানের মজুদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে নতুন ধান এলে দাম স্বাভাবিক হবে।

মিল মালিকরা জানান, বর্তমানে তারা প্রতি মণ ধান কিনছেন ৯৩০ থেকে ৯৪০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও এই ধান ছিল ৭৫০ টাকা। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমে আসায় ধানের দাম বাড়ছে। এতে মিলে চালের দাম বাড়তি। মিল গেটে আগে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ভালো মানের মিনিকেট ১ হাজার ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে বিআর আটাশ চালের দামও। অন্যান্য চালের দামও বস্তায় গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি রয়েছে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজারের বাদামতলী ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে পাইকারিতে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন  বলেন, মৌসুমের শেষ সময়ে ধানের দাম বৃদ্ধিতে মিলগুলো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এ কারণে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ছে।

আগে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, যা গতকাল রোববার বিক্রি হয়েছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। ২৮ থেকে ২৯ টাকা কেজি বিআর-২৮ ও লতা চাল এখন ৩০ থেকে ৩১ টাকা হয়েছে। এছাড়া ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি নাজিরশাইল চালের দাম বেড়ে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে মিনিকেট ও বিআর আটাশ চালের চাহিদা রয়েছে। এই দুই পদের চালের দাম বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়, যা আগে ৪০ থেকে ৪২ টাকা ছিল। এছাড়া বিআর-২৮, লতাসহ অন্যান্য মাঝারি মানের চাল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল, যা এখন খুচরায় ৩৩ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে নাজিরশাইল চাল কেজিতে ২ টাকা বেড়ে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুদ রয়েছে ১২ লাখ ৩৯ হাজার টন। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ২৬ টাকা এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকায়। চলতি আমন মৌসুমে সরকার ছয় লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনবে। সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে ৩৬ টাকা দরে তিন লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা দরে ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে। কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকায় কেনা হবে। আগামী ২০ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু হবে এবং ১ ডিসেম্বর থেকে চাল কেনা শুরু হবে। এই সংগ্রহ অভিযান ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলমান থাকবে। প্রতি কেজি আমন ধানের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ২১ টাকা ৫৫ পয়সা। আমন মৌসুমে ধান ১ কোটি ২ থেকে ৩ লাখ টন এবং আউশ ২৬ থেকে ৩৬ লাখ টন উৎপাদন হয়ে থাকে। এবার বোরো মৌসুমে প্রায় ২ কোটি টন ধান উৎপাদন হয়েছে। তখন বাম্পার ফলন এবং দাম না পেয়ে মাঠেই ধান পুড়িয়ে ফেলেছিলেন কৃষক। তখন কৃষকের অভিযোগ ছিল, মিলাররা ঠিকমতো ধান কিনছেন না। বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা মণেও ধান বিক্রি করছেন তারা। এর পরে গত মে মাসে চাল আমদানিতে শুল্ক্ক দ্বিগুণ করা হলেও কৃষকরা সুফল পাননি। বোরো মৌসুমের পরে পাঁচ মাস যেতে না যেতেই চালের দাম বাড়ল।

এদিকে গত দু'দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে খুচরায় প্রতি কেজি দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ ১৫০ টাকা ও কিং জাতের পেঁয়াজ ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। আমদানি করা পেঁয়াজও ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তেজগাঁও কাঞ্চনপুর স্টোরের ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে সাধারণ মানের পেঁয়াজ ১৩০ টাকা কেজিতে কিনে ১৪০ টাকায় বিক্রি করছেন।

পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে। গতকাল শ্যামবাজারের আড়তে দেশি পেঁয়াজ ১৩০ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১২০ টাকা, মিসরের ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও গত বৃহস্পতিবার পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা বন্ধে উদ্যোগ নিয়ে দাম নির্ধারণ করেছিল শ্যামবাজার বণিক সমিতি। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল মিসর, চীন ও তুরস্কের পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হবে। কিন্তু বাজারে ওই দরে এখন কোনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে না। কারওয়ান বাজারের পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছে। গতকাল দেশি পেঁয়াজ ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানীতে দাম বৃদ্ধির চেয়ে মোকামে আরও বেশি বেড়েছে। পাবনা ও ফরিদপুরের আড়তে প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ১৪০ টাকায় বেচাকেনা হয়। এই পেঁয়াজ রাজধানীতে এলে দাম আরও বাড়বে বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে দু'দিন খালাস বন্ধ থাকায় আমদানি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। চীন, মিসর ও তুরস্কের পেঁয়াজ পাইকারি আড়তে তেমন সরবরাহ নেই বলে জানান শ্যামবাজারের পপুলার বাণিজ্যালয়ের পাইকারি ব্যবসায়ী রতন সাহা। তিনি বলেন, সরবরাহ না বাড়ানো পর্যন্ত দামের সমাধান আশা করা ঠিক হবে না।

জানা যায়, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পরে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানির অপেক্ষায় আছে ৬১ হাজার টন। বড় গ্রুপগুলো আমদানির উদ্যোগ নিলেও তা এখনও দেশে আসেনি।