আইন ও আদালত ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০২:৫৮

হত্যা নাকি দুর্ঘটনা, রহস্যের কিনারা চায় রাকিবের পরিবার

ডেস্ক রিপোর্ট ।।

শুধুই কি একটি দুর্ঘটনা নাকি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড? সাজানো গল্পের শুরুটা এরকম, 'মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর পার্কিং করে রাখা একটি কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে পেছন থেকে গিয়ে ধাক্কা লেগে দুমড়েমুচড়ে যায় প্রাইভেটকার। এ সময় ভেতরে থাকা তিনজনের মধ্যে রাকিব গুরুতর আহত হয়। অপরদিকে গাড়ির চালকের আসনে থাকা রাফিদ তখন পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় তৃতীয় ব্যক্তি সাদি কোনো রকমে ভাঙাচোরা প্রাইভেটকারটি চালিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার সিটি ফিলিং স্টেশনের কাছে পৌঁছলে পুলিশের সামনে পড়ে। পুলিশ দেখে ভয়ে পালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ সাদিকে আটক করেন। প্রাইভেটকারের ভেতর থাকা রাকিবকে আহতাবস্থায় রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।'

চলতি বছরের ৬ জুলাই; রাত ১০টা ৪০ মিনিট। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী শিউলী বেগম মোবাইল ফোনে কল পান এক অচেনা নম্বর থেকে। ফোনের ওপাশ থেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে জানানো হয়, তার ছেলে ইরফান খান রাকিব (১৭) মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর মডার্ন হারবাল সেন্টারের উল্টো পাশে 'দুর্ঘটনার' শিকার হয়েছে। এখন সে তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনে আছে।

খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বজনরা। ততক্ষণে রাকিবকে অবশ্য পাঠানো হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে রাকিব 'সড়ক দুর্ঘটনায়' মারা গেছে, এটা বিশ্বাস করছে না তার পরিবার। কারণ এমন কিছু ক্লু ও তথ্য পাওয়া গেছে, যেসব থেকে তারা মনে করছেন, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেই দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছে। ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগেই রাকিবকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল বখাটে তরুণ শাহরিয়ার জয়। 'বড় ভাই' না বলায় তাকে এ হুমকি দেওয়া হয়। এলাকার 'বড় ভাই' মমিনকে দিয়ে রাকিবকে হত্যা করা হবে বলে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে রাকিবকে জানিয়েছিল জয়।

এদিকে দুর্ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে রাকিবের 'বড় ভাই' হিসেবে পরিচিত একই এলাকার বাসিন্দা জামিল হায়দার চৌধুরী একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, 'মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় রাকিব চলে গেল না ফেরার দেশে'।

আবার ঘটনার 'প্রত্যক্ষদর্শী' রাকিবের সিনিয়র বন্ধু সাদি দুর্ঘটনাস্থল হিসেবে যে স্পটের কথা বলছে, সেখানে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার সময় রাকিবের প্রাইভেটকারে ছিল সাদি। রাকিবের দু'টি মোবাইল নম্বরের বিভিন্ন তথ্যও রহস্যজনকভাবে কেউ মুছে দিয়েছে।

রাকিবের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা দীল মোহাম্মদ খান বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছিলেন। সেই মামলার এজাহারের তথ্য পাল্টে দেওয়া হয়েছে- বাদ দেওয়া হয়েছে সন্দেহভাজনদের নাম। যদিও বাদী এর কিছুই জানেন না। ভুল তথ্যের এই এজাহার তৈরির পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক অনাথ মিত্রও রহস্যজনক আচরণ করছেন। বাদী পক্ষ থেকে যেসব ক্লু দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি। রাকিবের পরিবার ছেলের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে আলামতের সন্ধানে থাকলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ব্যস্ত ছিলেন সন্দেহভাজনদের আড়াল করায়। বাদী পক্ষের অভিযোগ, সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে অনাথ মিত্র তদন্তে গা লাগাননি। এটিকে 'দুর্ঘটনা' প্রমাণে মরিয়া ছিলেন তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে ডেকে সতর্ক ও ভর্ৎসনা করলেও কোনো তোয়াক্কা করেননি এই তদন্ত কর্মকর্তা। এ অবস্থায় পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে আবেদন করে মামলাটি থানা থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে স্থানান্তর করেছে বাদী পক্ষ।

কী ঘটেছিল : সিদ্ধেশ্বরীরের খন্দকার রোডের বাসিন্দা দীল মোহাম্মদ খানের ছেলে ইফরান খান রাকিব মগবাজার ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ৬ জুলাই সন্ধ্যার পর রাকিব তার বোনের স্বামীর প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ-৪২-২৭৪৯) নিয়ে বন্ধু রাফিদসহ বেড়াতে যায়। প্রাইভেটকার চালাচ্ছিল রাফিদ। ভিকারুন্ননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গাড়িতে ওঠে রাকিবের বন্ধু সাদি। তিন বন্ধু প্রাইভেটকার নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ায়।

সাদির ভাষ্যমতে, মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর পার্কিং করে রাখা একটি কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে পেছন থেকে গিয়ে ধাক্কা লেগে দুমড়েমুচড়ে যায় প্রাইভেটকার। এ সময় রাকিব গুরুতর আহত হয়। গাড়ির চালকের আসনে থাকা রাফিদ তখন পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় সাদি কোনো রকমে ভাঙাচোরা প্রাইভেটকারটি চালিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার সিটি ফিলিং স্টেশনে আসে। এ সময় প্রাইভেটকারের সামনে একটি পুলিশের গাড়ি পড়ে। পুলিশের গাড়ি দেখে ভয়ে সাদি পালানোর চেষ্টা করে। স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ সাদিকে আটক করে। প্রাইভেটকারের ভেতর থাকা রাকিবকে আহতাবস্থায় রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়।

রাকিবের বান্ধবী যা বলছেন : রাকিবের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী সামায়রা মেহজাবিন শ্রাবণী। ঘটনার বিষয়ে শ্রাবণী জানায়, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার সঙ্গে কথা হয় রাকিবের। তখন রাকিব বলেছিল, তারা তিন বন্ধু মিলে মদ খাচ্ছে। সেখানে রাফিন ও সাদি রয়েছে। শুনে শ্রাবণী বলে, মদ খাওয়ার কথা জানতে পারলে রাকিবকে তার বাবা-মা বকবেন। রাকিবকে সে দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে বলে। এরপর রাকিবকে ভালোভাবে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাফিনকেও অনুরোধ করে সে।

ওই দিনই ১০টা ২ মিনিটের দিকে শ্রাবণীকে আবারও ফোন করে রাকিব। বন্ধুদের কথায় যাতে কষ্ট না পায়, সেজন্য শ্রাবণীকে অনুরোধ সে। এরপরই রাত ১০টা ১০ মিনিটের দিকে রাকিবের আরেক বন্ধু রাজা ফোন করে শ্রাবণীকে দুর্ঘটনার খবর জানায়। পরে রাজা শ্রাবণীকে আরও জানায়, ঘটনার সময় রাফিন রাকিবের গাড়িতে ছিল না। রাফিন নোয়া ব্র্যান্ডের আলাদা গাড়িতে ছিল। আর রাকিবের আরেক বন্ধু সাবাব আরেকটি গাড়ি চালাচ্ছিল। তিনটি গাড়ি পরপর চলছিল। রাজা জানে না, 'দুর্ঘটনার' পর অন্য দুটি গাড়ির কথা গোপন করা হচ্ছে। শ্রাবণী বলে, সাদি নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। তার ভাষ্যমতে, রাফিদ নামে রাকিবের কোনো বন্ধুই নেই। অবশ্য রাফিন নামে রাকিবের এক বন্ধু আছে। কিন্তু রাফিন রাকিবের সঙ্গে গাড়িতে থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

যে কারণে সন্দেহ : রাকিবের বাবা দীল মোহাম্মদ খান ছেলের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ঘটনার দু'দিন আগে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় রাকিব তাকে জানিয়েছিল, জয় নামে এক বন্ধু তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। জয় নিয়মিত মদ খায়। রাকিবকে তার গাড়ি নিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে বলে। জয়কে 'আপনি' বলার জন্য শাসিয়েছে সে। কথা না শুনলে রাকিবকে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে বলে হুমকি দিয়েছে জয়।

দীল মোহাম্মদের ভাষ্য, জয়ই কৌশলে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে তার ছেলেকে হত্যা করেছে। ঘটনার পর গাড়িতে থাকা সাদির কথায়ও অনেক অসংলগ্নতা রয়েছে। সাদি যে দুর্ঘটনাস্থলের কথা বলছে, সেখানে গিয়ে ভাঙা কোনো কাচ পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন ভোর রাতেই দীল মোহাম্মদ কথিত 'দুর্ঘটনাস্থলে' গিয়ে আলামত খুঁজেছেন। সেখানে অন্য একটি গাড়ির লুকিং গ্লাস পেলেও রাকিবের গাড়ি ভাংচুরের কোনো প্রমাণ মেলেনি। এমনকি যে কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে পেছন থেকে ধাক্কা লাগার কথা বলা হচ্ছে, সেটিরও কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। এ রকম ক্ষেত্রে ভ্যান মালিকের নিশ্চয়ই ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে ভ্যান মালিক কেন হাওয়া হয়ে যাবেন? মগবাজার ফ্লাইওভার ও আশপাশের এলাকায় একাধিক সিসিটিভি রয়েছে। থানা পুলিশ কোনো ফুটেজ সংগ্রহ করে ওই স্পটে দুর্ঘটনা হয়েছিল তা যাচাই করেও দেখেনি বলে জানান তিনি।

দীল মোহাম্মদ প্রশ্ন করেন, মগবাজার 'দুর্ঘটনাস্থল' হলে আশপাশের একাধিক হাসপাতালে নেওয়ার বদলে রাকিবকে কেন তেজগাঁও পর্যন্ত আনা হলো? পুলিশ দেখেই বা কেন 'দুর্ঘটনাকবলিত' বন্ধুকে রেখে পালিয়ে যাবে সাদি ও রাফিদ? তিনি জানান, সাদির কথামতো কাভার্ডভ্যানকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে প্রাইভেটকারের সামনের দিকে ক্ষতি হওয়ার কথা। কিন্তু 'দুর্ঘটনাকবলিত' গাড়ির বাঁ পাশ দুমড়ানো ছিল। দেখে যে কারও মনে হবে, কোনো গাড়ি পাশ থেকে ধাক্কা দিয়েছে।

পুলিশের সীমাহীন গাফিলতি : ঘটনার পরপরই রাকিবের পরিবারের পক্ষ থেকে হাতিরঝিল থানায় একটি অভিযোগ করা হয়। সেখানে বলা হয়, 'দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে রাকিবকে তার বন্ধুরা অজ্ঞাত কারণে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে কি-না সে ব্যাপারে তদন্ত করা আবশ্যক।' কিন্তু অভিযোগ থেকে এ বক্তব্য সরিয়ে মূল এজাহার নেওয়া হয়। শুরু থেকেই বাদী পক্ষ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের অনুরোধ করে আসছিল। তাদের মধ্যে ছিল রাকিবের গাড়িতে থাকা সাদি ও রাফিদ। এ ছাড়া ছিল রাকিবের বন্ধু শ্রাবণী, জয়, রাজা, সাবাব ও মবিন। অথচ তদন্তের স্বার্থে হলেও তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। জয় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তার বাসা শিল্পকলা একাডেমির পাশে। রাকিব একসময় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে পড়ায় জয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। সন্দেহভাজনদের অনেকেই ইতিমধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে। দু'জন পালিয়ে গেছে বিদেশে।

রাকিবের বাবা দীল মোহাম্মদ খান বলেন, কোনো আলামত নিয়ে গেলেই দুর্ব্যবহার করে তদন্ত কর্মকর্তা বলতেন, কী কবিতা নিয়ে এসেছেন? তদন্ত কর্মকর্তা যদি প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে বলতেন, ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছে, তা হলেও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। এ ঘটনার পেছনে নারীঘটিত কোনো রহস্য থাকতে পারে। হাতিরঝিল থানার ওসির যোগসাজশে শুরু থেকে অসহযোগিতা করেছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। নামকাওয়াস্তে জিজ্ঞাসাবাদ করে সাদিকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে থানা পুলিশ।

সংশ্নিষ্টদের বক্তব্য : মামলার তদন্তে গাফিলতির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অনাথ মিত্র বলেন, 'তদন্ত কীভাবে করেছি, এটা কেন গণমাধ্যমকে বলব? কেন এই জবাব দিতে যাব? পিবিআই বিশেষ সংস্থা। তারা এখন বের করুক কী ঘটেছিল। কেউ কি পুলিশের জন্য টাকা নিয়ে বসে থাকে যে সেখান থেকে টাকা নিয়ে মামলা ভিন্ন খাতে নেব?'

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক মজিবুর রহমান বলেন, মামলা পিবিআইতে আসার পর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে। এ ঘটনার নেপথ্যে কী রয়েছে, তা বের করা হবে।