নিজস্ব প্রতিবেদক
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কারণে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। সদ্য ক্ষমতাচ্যূত দল আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের দায়িত্বগ্রহনের আজ এক মাস পূরণ হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার করছেন। রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠনে জোর দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। অনেকে আবার গ্রেফতারও করা হয়েছে। দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সরকারঘনিষ্ঠ উচ্চ পর্যায়ের আমলারাও গা-ঢাকা দেন। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনগণ। কর্তৃত্বপরায়ণ হাসিনা সরকারের নৃশংস দমন-পীড়নে প্রাণ হারায় শিশু-কিশোর-শিক্ষার্থী-নারীসহ হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে জনতার এ বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন আন্দোলনকারীরা।
জানা গেছে, স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। সেই জায়গাগুলো সংস্কারের জোরদার করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হচ্ছে স্বৈরশাসকের নিয়োগপ্রাপ্ত সকল কর্মকর্তা, প্রশাসক ও বিচার বিভাগেও। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করতে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ।
গত ৮ আগস্ট শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ উপদেষ্টা। পরদিন শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে ১১ আগস্ট শপথ নেন উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায় আর ১৩ আগস্ট শপথ নেন আরেক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। ১৬ আগস্ট বিকেল আরো চার উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের শপথ পাঠ করান। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ২১জন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন ইউনুস সরকার। তার মধ্যে রয়েছে, জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানানো; শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির উদ্যোগ, সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির উদ্যোগ; ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন; দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড় শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু; ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা; গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে—এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত।
এছাড়া বলপূর্বক গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর ও বিগত সরকারের আমলে সংগঠিত গুমের ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন; দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন; আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন; স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন; সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ প্রদান এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানানো; দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু, শুক্রবারও মেট্রোরেল চালু রাখার সিদ্ধান্ত; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো ও দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪দলীয় জোট ছাড়া অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। সেখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সাক্ষাৎ করেন। দলগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠকে রাজনীতিতে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সংস্কার এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। এছাড়া সম্পাদকমন্ডলীর সাথেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
এমএসআ






















