নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া হিসেবে ‘গণভোটে’ একমত পোষণ করেছেন গণঅভুত্থানের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো। সেই গণভোট কবে ও কী ভাবে হবে সেটা নিয়ে যত আলোচনা। কেউ বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে আলাদা ব্যালট পেপারের মাধ্যমে জনরায় নিতে, আবার কেউ বলছেন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গণভোট অনুষ্ঠিত করতে। সময়ে আটকে আছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। তবে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আগামী ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বৈঠক করবেন। আগামী দু’একদিনের মধ্যে কমিশন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আবারও বৈঠকে বসবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর খসড়া চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ কারণে আটকে আছে জুলাই সনদ। বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করতে এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কমিশন। ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিন আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে আজকের আলোচনায় অনেকে এ বিষয়ে কিছুটা সরে এসে গণভোটের ব্যাপারে মত দিয়েছেন বলে বৈঠক সুত্র জানা গেছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চতুর্থ দিনের আলোচনা রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে আবারও বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি আজ রোববার বেলা পৌনে ১২টায় শুরু হলেও বিকাল পাঁচটার দিকে শেষ। মাঝে দুপুরের খাবারের বিরতি ছিল।
দিনব্যাপী আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ ইস্যুতে গণভোটের পক্ষে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। আজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের সম্মতি অর্জনের জন্য গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের রায় নেয়ার জন্য সংসদ নির্বাচনের দিনে আলাদা ব্যালেটের কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জাতীয় সনদের বিষয়ে আমরা পুরোপুরি যেভাবে ঐক্যমত হয়েছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিসেন্ট, সেটা বাস্তবায়ন করতে পরবর্তী সংসদের সব সদস্য তাতে বাধ্য থাকবে। সেই জন্য জুলাই সনদের পক্ষে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য সংসদ নির্বাচনের দিনে আরেকটি আলাদা ব্যালেট রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা মনে করি, এর জন্য সংবিধানে আলাদা সংশোধনী আনার প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের বিষয়ে কোনও আপত্তি নেই। সংবিধানেও এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সেই জন্য আমরা বলেছি, একটা অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। যাতে নির্বাচন কমিশন এই গণভোটটা পরিচালনা করতে পারে। সেই অধ্যাদেশের নাম হতে পারে, জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রস্তাব আকারে তুলে ধরেছিল কমিশন। সে প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এরপর আদেশটি নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা যেতে পারে। তবে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। পরে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দুই দিন আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে। সেই বৈঠকে শেষে আজকের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো ‘সংবিধান আদেশ’ থেকে সরে এসে গণভোটের প্রস্তাবে একমত পোষন করেন।
অন্যদিকে আজকের বৈঠকে গণভোটের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীও একমত পোষন করেছে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই গণভোট চেয়েছেন দলটি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। বৈঠকের মধ্যভোজের বিরতিতে সাংবাদিকদের কথা বলেন এই নেতা। গণভোট কবে হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত নয়। আমরা মনে করি, এটি যাতে জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যায় না ফেলে, নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরেই এটা করা যায়। নির্বাচনের তফসিলের আগেও করতে পারেন। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় না ফেলে বা মহাপরীক্ষায় না ফেলে সহজভাবে এগিয়ে গেলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচনার জন্য যদি গণভোটে যায়, তাহলে এটা হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টও এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহŸায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, এ সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কারণ পরবর্তী সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা বাদ দিয়ে দিতে পারে। তাই জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। যেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভ‚ঁইয়া মঞ্জু বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে সরকার বদল হয়নি। এবি পার্টির পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা আদেশ আকারে জারি করতে পারেন। এজন্য একটা গণভোট হতে পারে। গণভোটের মাধ্যমে মতামত নেব।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন একইসাথে গণভোটও চাই। বিচার বিভাগের মতামত নেওয়ার পক্ষে তবে বাধ্যতামূলক নয়, পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে বলেও জানান সাইফুল হক।
এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যের কাছাকাছি। অনৈক্য দূর হয়ে ন্যূনতম ঐক্যের জায়গায় পৌঁছেছি আমরা। গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন হতে পারে। যেহেতু নির্বাচন পিছিয়ে যায় কিনা এমন শঙ্কা আছে যার ফলে নির্বাচনের দিনই আয়োজন করলে ভালো।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৮০ শতাংশ ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।






















