বিশেষ প্রতিনিধি, ২০২২ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগের নির্বাচনের আলোকেই ফিরতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শিগগিরই এই রূপরেখা তুলে ধরবে দলটি। এ নিয়ে একটি খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা।
সূত্রমতে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় চলমান সংলাপে এ বিষয়ে মত নেওয়া হচ্ছে। এতে নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ও দশজন উপদেষ্টা রাখার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি দল এবং বিরোধী দল মিলে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্যে এমন একজন সম্মানিত নাগরিক হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে সংবিধানের এয়োদশ সংশোধনী পাশ করে। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নেয়। ২০১১ সালে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়।
একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলনেই সমাধান দেখছে দল। সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও ইতোমধ্যে নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে।
সরকারকে মনে রাখতে হবে দেশের জনগণের জন্য সংবিধান। সুতরাং জনগণের প্রয়োজনে তা সংশোধনও করতে হবে। যেমনটা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে অনীহা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধান সংশোধন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বাতিল এয়োদশ সংশোধনীর আলোকেই বিএনপি সময়মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে। যুগপৎ আন্দোলন শুরু করলে জানতে পারবেন। সংবিধানের ৫৮(খ), (গ)-সহ যেসব অনুচ্ছেদ (ত্রয়োদশ সংশোধনী) ছিল তারই আলোকে এই রূপরেখা হবে। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপের পর মহাসচিব এ কথা বলেন।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির ওই রায়কে ভিত্তি ধরেই সংবিধান সংশোধন করে সরকার, যাতে বিলুপ্ত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে এর আওতায় আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন চারজন বিচারপতি। এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন দুজন বিচারপতি। আর একজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।
তিনি বলেন, এরপরের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতেই পারে। তবে এ বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্রমতে, বিএনপি যে রূপরেখার খসড়া তৈরি করছে সেখানে বাতিল হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর ৫৮গ অনুচ্ছেদে যা ছিল তা থাকবে। সে অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১ সদস্যের বেশি হবে না। এর মধ্যে একজন প্রধান উপদেষ্টা ও অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা থাকবেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হবেন। উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন। উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতায় বলা হয়েছে, তাদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো সংগঠনের সদস্য হবেন না, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী নন বা প্রার্থী হবেন না এ মর্মে লিখিতভাবে সম্মত হতে হবে।
বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক জানান, রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, বিদায়ি প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। তাই বিচারপতিকে এ ব্যবস্থায় দেওয়া যাবে না বলে আদালতের রায় আছে। বিএনপির খসড়ায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করা বিষয়ে বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যেই এই রূপরেখা দেবে বিএনপি। সরকারকে আরও চাপে ফেলতে আগেই বিএনপির সংসদ সদস্যদেরও পদত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে রাখার বিষয়েও বলা হয়েছে।


















