রাজনীতি ৮ নভেম্বর, ২০২২ ০৪:৪৩

‘ভারপ্রাপ্ত’ থেকে ‘ভারমুক্ত’ তবুও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ জয়-লেখক

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০ তম সম্মেলন। সম্মেলন ঘিরে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা দিলেও ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হওয়া আল নাহিয়ান খান জয় লেখক ভট্টাচার্যের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, ছাত্রলীগের যে ইতিহাস ঐতিহ্য, সেটি ধারণ করতে পারেননি জয়-লেখক!

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হন রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন গোলাম রাব্বানী। ধারাবাহিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অভিযোগ সমালোচনার মুখে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাদের। সংগঠনের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং বিতর্কমুক্ত করতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আল নাহিয়ান খান জয় লেখক ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে দুই শীর্ষ নেতাকে ভারমুক্ত করে পূর্ণ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ভারপ্রাপ্ত ভারমুক্ত হয়ে তিন বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা নির্দেশনা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন জয় লেখক। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ, গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠন পরিচালনা করেছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। বিতর্কমুক্ত সংগঠন উপহার দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও উল্টো তাদের কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ ধারার ()-তে বলা আছে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা বসবে। অন্য সব নিম্নতম শাখায় নির্বাহী সংসদের সভা বসবে প্রতি মাসে অন্তত একবার। হিসাবে জয়-লেখক কমিটির তিন বছরে দুই মাস পরপর ১৮টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র একটি।

গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১১ ধারার ()-তে বলা আছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল দুই বছর। সময়ের মধ্যে সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে। এটিও পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন জয়-লেখক। পরে নেতাকর্মীদের দাবির মুখে গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়।

জানা যায়, ১১৯টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে মাত্র ৩৮টি জেলা কমিটি দিতে পেরেছেন জয়-লেখক। বাকি ৮১টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি তারা। গঠনতন্ত্রে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণার কথা থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া প্রত্যেকটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০টির মতো শূন্য পদ থাকলেও এর বিপরীতে বর্ধিত কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে কয়েকশ নেতাকে। ফলে ছাত্রলীগের মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

নেতাদের অভিযোগ, গঠনতন্ত্রের বাইরে সংগঠন পরিচালনায় জবাবদিহিতার ভয়ে তারা কার্যনির্বাহী কমিটির সভার আয়োজন করেননি। সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতও নেননি তারা। বিলম্বে কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন হলেও কমিটি গঠনে তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও তা পেছাতে গড়িমসি করেছেন জয়-লেখক।

কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশের অভিযোগ, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সংগঠন পরিচালনা এবং বর্ধিত কমিটিতে অতিরিক্ত পদায়ন করে ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করেছেন তারা (জয়-লেখক) বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সন্তান, বিবাহিত মাদকসেবীদের দিয়ে কমিটি গঠন এবং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ তুলেছেন নেতারা। যদিও জয়-লেখক এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন।

অন্যদিকে, মেয়াদ শেষ হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর দক্ষিণের সম্মেলনের বিষয়ে এখনও কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যদিও কেন্দ্রের আগে তিন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের সম্মেলন করার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত শীর্ষ কয়েকটি কমিটির মধ্যে ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বাঙলা কলেজ সোহরাওয়ার্দী কলেজের কমিটি দিতে পারেননি জয়-লেখক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। ওই বছরের ২৯ জুলাই সনজিত চন্দ্র দাসকে সভাপতি এবং সাদ্দাম হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। চার বছর পার হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলন প্রস্তুতির কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি। এখন পর্যন্ত বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াজ-আল রিয়াদ বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর জয়-লেখক সংগঠনের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন। অন্যত্র মনোযোগ দেন তারা। গঠনতন্ত্র না মেনে, সাংগঠনিক কার্যক্রম পালন না করে তারা গা-ভাসিয়ে চলেছেন। রাতের আঁধারে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিলে স্বাভাবিকভাবেই অনিয়মের প্রশ্ন ওঠে এবং তা খণ্ডনেরও কোনো উপায় থাকে না।

বর্ধিত কমিটির নামে অসংখ্য নেতাকর্মীকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও নানা অভিযোগ রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী সভা ডাকার কথা। সেটাও করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। সম্মেলনের ঘোষণা ইতোমধ্যে এসেছে। এখন আমাদের নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।

অপর সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন, নেত্রীর প্রত্যাশা পূরণে জয়-লেখকের অনেক দায়বদ্ধতা ছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলে ছাত্রলীগের ইতিহাসে তারা নাম লেখাতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা পারেননি। তাদের কারণে, আমার মনে হয় তারা আস্তাকুঁড়ে পতিত হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছেন।

একনায়কতন্ত্র মনোভাব, সহপাঠীদের আড়ালে রেখে এবং তাদের কোনো কার্যক্রমে না লাগিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে জড়ানোয় জয়-লেখক সংগঠনকে আজ এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন দিতে তারা গড়িমসি করেছেন। এর দায় তাদের নিতেই হবে।

ছাত্রলীগ নেতাদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেননি। তাদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা দেওয়া হলেও তারা কোনো উত্তর দেননি।

তাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলার অভিযোগ বেশ পুরোনো।

গত নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী তারিখ নির্ধারণ করেন। সম্মেলন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শত শত নেতাকর্মী দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য কাঙ্ক্ষিত পদ পাওয়া। কারণে তারা নিজ নিজ অঞ্চল ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। মধুর ক্যান্টিনে দেখা যাচ্ছে পদপ্রত্যাশীদের সরব উপস্থিতি।

 

 

 

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর