রাজনীতি ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৪:১৭

হতাশার দোলাচলে আ.লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব

আমাদের কাগজ রিপোর্ট: প্রত্যাশা প্রাপ্তির যোগফল ভীষণ ফারাক সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কমিটিতে, এমন দাবি করেছেন দলটির অন্তত দুই ডজন কেন্দ্রীয় নেতা। তারা বলছেন, ফারাক কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে, যে কারণে দলীয় কাজকর্মে নিষ্ক্রিয় অনেকেই। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেককেই এখন দলীয় কার্যালয়ে দেখা যায় না।

 

ক্ষমতাসীন দলটির সভাপতিমন্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নির্বাচিত নেতারা বলেন, ভালো কাজের মূল্যায়ন স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন তারা। ২০০৯ থেকে গত বছর ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়েছে পাঁচটি। একই পদে থাকা একাধিক নেতার পদোন্নতি বা পদাবনতি কিছুই হয়নি। এটিও হতাশার বা নিষ্ক্রিয় থাকার অন্যতম কারণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, ধরনের সমস্যা নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটায়।

ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচন দেখে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা মনোবেদনায় ভুগছেন। অল্পসংখ্যক নেতা যারা কাজ না করেও পদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন, ভালো আছেন তারাই।

সম্প্রতি সভাপতিমন্ডলী সম্পাদকমন্ডলীর একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাদের হতাশা মনোবেদনা গোপন করেননি তারা। কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পদে থাকা নেতারা দাবি করেন, কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সারা বছর কাজ করা নেতারা পদোন্নতি যেমন পাননি দলের জন্য কাজ না করা নেতাদের পদাবনতিও ঘটেনি। নীতি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করায় নেতারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। হতাশা হয়েছেন। এমনটা হলে সংগঠনকে শক্তিশালী গতিশীল করার কাজে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা বলেন, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কায় রাগ-ক্ষোভ ভেতরে পুষে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন নেতারা। উচ্চবাচ্য করার সুযোগ নেই তাদের।

গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। এক দিনের সম্মেলনে বিকেলের অধিবেশনে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক রেখেই কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে নতুন তিন-চারজন যোগ হয়েছেন। কয়েকজন বাদে পুরনোরা সবাই থেকে গেছেন। পদোন্নতি বা পদাবনতি তেমন হয়নি। এর আগে আওয়ামী লীগের তৃণমূল সম্মেলনেও পুরনো নেতৃত্ব বহাল রেখে কমিটি করা হয়। নিয়ে তৃণমূলেও হতাশা-ক্ষোভ দেখা গেছে।

অবশ্য এবারের জাতীয় সম্মেলনে সক্রিয় নেতার বাদ পড়ার নজিরও আছে। গত কমিটি থেকে বাদ পড়া কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, সম্মেলনে কমিটি নির্বাচন দেখে মনে হয়েছে আমাকে বাদ দিতেই সম্মেলন। সামাজিকভাবে পরিবারের সদস্যদের কাছে আমি খুব লজ্জা পেয়েছি। আমি বাদ পড়ার কারণটাও খুঁজে পাই না।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছেন। কিন্তু মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম মাহাবুবউল আলম হানিফসহ দুই-তিনজনকেই ঘুরেফিরে কর্মসূচিতে দেখা যায়। সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় এক নেতাকে একটি মাত্র কর্মসূচিতে দেখা গেছে। অন্য এক নেতা বিদেশে গিয়ে বসে আছেন। আগে সক্রিয় ছিলেন এমন আরেক নেতাকে আর কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ধানমন্ডিতে সভাপতির কার্যালয়ে আগে নেতাদের ঘিরে নিচের দিকের নেতা কর্মীদের আড্ডা হতো। সেই আড্ডায় এখন ভাটা দেখা যাচ্ছে।

গত ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জনসভায় কেন্দ্রের ডজনখানেক নেতাকে মঞ্চে দেখা গেছে। সাধারণত দলীয়প্রধানের জেলা সফরে কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতাই থাকেন। নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে করছেন কোনো কোনো নেতা। তারা বলেন, দিনরাত খাটাখাটুনি করা নেতারা যে ফল পেয়েছেন এবং দলীয় কার্যক্রমে না থেকে পদকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা নেতারাও একই ফল পেয়েছেন। তাহলে আর খাটুনি করে লাভ কি? তারা দাবি করেন, ধারা দলকে দলীয় রাজনীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলবে।

কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া নেতারা বলেন, দলীয় কাজে সক্রিয় থাকতে মন সায় দেয় না এখন। চলছেও তাই। সম্মেলনের পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি তেমন লক্ষণীয় নয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ধানমণ্ডিতে সভাপতির কার্যালয়ের চিত্র দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা। বেসরকারি টেলিভিশনে টক শোতে অনেক নেতা যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

দলের দুটি কার্যালয়ের সহকারীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সম্মেলনের পর একদিনও এখানে আসেননি এমন দুই ডজন নেতা রয়েছেন। তারা বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে নেতাদের নামে যেসব চিঠি আসে সেগুলো বিলি করতে হয় তাদের বাসায় গিয়ে। অফিস সহকারীরা আরও বলেন, অনেক কেন্দ্রীয় নেতা দেশের বাইরে গেছেন এবং পরিবার-পরিজনকে সময় দিচ্ছেন। দেশে থাকা নেতারা বাসাবাড়িতে সময় কাটাচ্ছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভেতরে হতাশা বাসা বাঁধায় রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলার আশঙ্কা দেখছেন অনেকে। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় দলীয় ঐক্য দৃঢ় করে তোলার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোবলে চিড় ঐক্য প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) সম্মেলনের দিন মঞ্চেই ঘোষণা করেছেন সামনের নির্বাচন ঘিরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তেমন পরিবর্তন আনতে চান না। সে কারণেই কাউকে বাদ বা পদোন্নতি দেওয়া উল্লেখযোগ্য হারে হয়নি। যারা রাজনীতি করেন রাজনীতির স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত মানতে হয়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সম্মেলন মানে তিন বছর শেষে কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য একটি পরীক্ষার আয়োজন। তিন বছরের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া কাজ না করা নেতাদের বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিরস্কার করা। কার কী অবদান তার পরিমাপক হলো জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। সেখানে খাটাখাটুনির যাচাই করে কেউ মেধাতালিকায় জায়গা পান। আবার কেউ দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান লাভ করেন। ফেল করেন কেউ। প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গতিশীল হয়ে উঠে যেকোনো সংগঠন। কিন্তু গেল সম্মেলনের চিত্র হলো কেউ ফেল করেনি। সবাই গড়ে পাস করে গেছেন।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পরীক্ষার ফলাফলের চিত্র এমন হলে সারা বছর কাজ করার কী দরকার! পদোন্নতির প্রত্যাশা করা আওয়ামী লীগের নেতা সবাই এখন নীতি অনুসরণ করে চলতে মনস্থির করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, সম্মেলনের পর নেতা নির্বাচন দেখে প্রত্যেক কেন্দ্রীয় নেতা ভেতরে ভেতরে মানসিকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। ওপরে ওপরে সবাই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভেতরের অবস্থা তাদের নিষ্ক্রিয় করে তুলছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য বলেন, রাজনীতি এখন পাওয়ার হাউজকেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগ এখন পাওয়ার হাউজ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে রাজনীতিতে যতই সক্রিয় থাকি বা নিষ্ক্রিয় থাকি পাওয়ার হাউজ-এর কৃপা না পেলে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তাই রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার চেয়ে পাওয়ার হাউজের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশলে এগিয়ে যেতে চান অনেক নেতা।

রাজনীতির বাইরের এই পাওয়ার হাউজ একটি বলয়ে আবর্তিত জানিয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর ওই নেতা বলেন, দলের জন্য কাজ না করলেও রাজনীতির পদপদবি ধরে রাখা সম্ভব। খাটাখাটুনির রাজনীতি এখন কেউ করবে না।

 

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর