রাজনীতি ২১ মে, ২০২৩ ০৫:২৩

‘প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সংলাপে বসতে পারেন খালেদা জিয়া’

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজনৈতিক সংকট এখনো সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হয়নি। তা সত্ত্বেও রাজনীতিতে সংকট নিরসনে সংলাপ নিয়ে আলোচনা চলছে বিভিন্ন সময়ে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেও সংলাপের আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করায় আবারো রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় আলোচনায় এসেছে 'সংলাপ'। তবে বড় দুই দলের নেতারা সংলাপে বসতে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। আবার গোপন আলোচনায়ও দুই পক্ষের আগ্রহ দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গোপন সংলাপের পেছনে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি বড় অংশ প্রবীণ হয়ে পড়েছে। এ বছরের পর তাদের অনেকেরই ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছে। এ সময় তারা সংসদ সদস্য হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে চলতে চান। বিএনপির ওই অংশের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাও আছেন যারা নির্বাচনে যেতে চান। ফলে বিএনপির যেসব নেতা নির্বাচনে যেতে আগ্রহী তারা পর্দার আড়ালে থাকতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে দেখতে চায় বিদেশি শক্তির সরকারের ওপর চাপের কারণে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চায় আওয়ামী লীগ। ফলে প্রকাশ্য সংলাপে আগ্রহ না দেখিয়ে গোপন আলোচনায় আগ্রহী দলটির নেতারা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়বে না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বিরোধী দল বিএনপি। দুই দলই এমন অনড় অবস্থান দেখাচ্ছে। দুই পক্ষের বিরোধপূর্ণ অবস্থানের কারণে সৃষ্ট সংকট নিরসনে এরই মধ্যে বিদেশি তৎপরতা শুরু হয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক তৎপরতাও গতি পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি এখনো কাউকে ঘনিষ্ঠ অবস্থানে অর্থাৎ এক মেরুতে আনতে পারেনি। তবে বিদেশি প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরা সংকট নিরসনে উভয় পক্ষকে সংলাপে বসতে বলছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দেশের রূপান্তরকে বলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা উভয় পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদেশিদের অবস্থান হচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। সে জন্য ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে সড়ক নির্মাণের পরামর্শ দেন। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই সংলাপে অনীহা দেখিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে অনীহা প্রকাশ করেছেন। বিএনপিও প্রায় প্রতিদিনই অনিচ্ছা প্রকাশ করে বক্তৃতা দিচ্ছে।

তবে এর আগেও সংলাপে কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। এবারও সংলাপে সমাধানের সম্ভাবনা কম। সংলাপের আগে এজেন্ডা নির্ধারণ করলে সংলাপ সফল হওয়ার কোনো উপায় থাকে না।

দুই দলের একাধিক সূত্র আরও জানায়, খোলামেলা সংলাপের পরিবর্তে পর্দার আড়ালে সংলাপ হতে পারে। হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, 'এমন ঘটনা ঘটতে পারে- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করতে পারেন।' তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা নেই। রাজনীতিতে শব্দ। সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা একাধিক বৈঠক করেছেন। ওই সব বৈঠকে তারা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে উভয় দলের অবস্থান জানতে চান। একই সঙ্গে তারা দুই দলের কাছে এই বার্তা দিতে চায় যে, মতবিরোধ থাকলেও স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া জরুরি। এ কারণে নির্বাচনের আগে প্রধান দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে। এই সমঝোতার জন্য দুই পক্ষের মধ্যে একটি 'আলোচনা' হতে হবে, তা সংলাপ হোক বা আলোচনা হোক, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বা উভয়ই। এদিকে বিএনপি কোনো ধরনের সংলাপে আগ্রহী নয় বলে কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ। তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিদেশিদের প্রতি বিএনপির আচরণ তুলে ধরেন এবং সংলাপে বিএনপির অনীহা প্রকাশ করেন।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবি করছেন, রাজনীতিতে কিছু অর্জন করতে হলে আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতাসীন দলকে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু বিএনপি তা করতে পারছে না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করে। সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিএনপিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিএনপি এখন মনে করছে সে পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান রয়েছে। জনগণ সরকারের সঙ্গে আছে। আর জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। তাই খালেদা জিয়াকে এখনো মুক্ত করতে পারেননি।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, 'সংলাপের মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। সংলাপে বসলে হয়তো শতভাগ পাবো না। তবে কিছু গিভ অ্যান্ড টেক থাকবে। গণতন্ত্রে সংলাপের বিকল্প নেই।'

তবে দলটির সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ‘সংলাপ চলছে। মিডিয়ায়, টক শোতে, মাঠে মঞ্চে। এক দল আরেক দলকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তব্য দিচ্ছে, তাও এক ধরনের সংলাপ। এসব অনেকেই সংলাপ বলে টের না পেলেও মূলত এটাও সংলাপ।’

আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, সংলাপের ব্যাপারে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা তাদের তেমন কোনো পরামর্শ দেননি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘আমরা তাদের (কূটনীতিক) বলেছি সংলাপের উদ্যোগ আমরা নিয়ে কী করব? তাদের (বিএনপি) যদি কোনো দাবি থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে পারে। নির্বাচন কমিশন যদি সুপারিশ করে, সেটা অবশ্যই সরকারের কাছে আসবে। সরকার দেখবে তখন।’

সংলাপ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ভাবনা আমাদের নাই।’

সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকালীন এই সরকারই থাকবে এবং তাদের অধীনে নির্বাচনে হবে। নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সংকট সমাধানে কূটনীতিকদের দূতিয়ালি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক বিএনপি। সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার দূতসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না তা ব্যাখ্যা করেছে দলটি। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে কূটনীতিকদের বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি। আর এই সংকট মোকাবিলায় কূটনীতিকদের ‘রোল প্লে’ (ভূমিকা রাখা) করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, প্রকাশ্যে না হলেও পর্র্দার অন্তরালে সংলাপ হতে পারে। কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনেও গুঞ্জন রয়েছে ভেতর-ভেতর সংলাপ হচ্ছে।

গত ১৮ মে গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল অফিসার ব্র্যান্ডন স্কট, পলিটিক্যাল অফিসার ম্যাথিউ বে, পলিটিক্যাল কনসাল ড্যানিয়েল শেরির সঙ্গে দেখা করেন।

জানতে চাইলে শামা ওবায়েদ বলেন, কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তারা আমাদের অবস্থান জানতে চান। আসুন আমরাও আমাদের অবস্থান তুলে ধরি। সবশেষে তারা জানতে চান, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে আপনাদের অবস্থান কী। আমরা বলেছি, আন্দোলন চলছে, চলবে। তারাও অন্য দিকের কথা শুনছে (যারা ক্ষমতায় আছে)। এই অবস্থায় তারা কি করছে (দূতাবাস), নাকি অন্য কিছু তাদের ব্যাপার। তবে আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসা উচিত, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা উচিত, তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো বৈঠকে আনুষ্ঠানিক সংলাপের বিষয়ে কূটনীতিকরা আমাদের কিছু বলেননি।

তবে বৈঠকে উপস্থিত থাকা দলটির আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের সঙ্গে আমরা কয়েকবার সংলাপ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে সংলাপের পর নেতাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ঐক্যফ্রন্ট। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের তিন মাস পর নতুন নির্বাচন হবে বলে প্রতারণা করে তারা। তাই আমরা এজেন্ডা ছাড়া কোনো সংলাপে যাচ্ছি না। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বলেছি, আনুষ্ঠানিক সংলাপের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক। তবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে থাকতে হবে।


আমাদেরকাগজ/এইচএম