মো. সাইফুল ইসলাম,কক্সবাজার থেকে: দুর্গম দ্বীপ কুতুবদিয়া বিদ্যুতের আলোয় ছোয়ায় নানা সুবিধার। পাশাপাশি জীবনের প্রথম আইসক্রিম দেখেছে অনেকে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি প্রসূতি মায়েদের আর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় না। সিজারের ডেলিভারি হয় উপজেলা হাসপাতালেই।
মাত্র দুইমাস আগে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর পর এমন চিত্র ফুটে উঠে। যার ফলে ওই এলাকার আর্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্ধারা।
দেশব্যাপী শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে 'হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন' প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ রয়েছে।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে স্বাভাবিক লাইন নির্মানের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোন সুযোগ না থাকায় সাবমেরিন ক্যাবল ব্যাবহার করা হয়েছে। এটি ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিলো।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিংসহ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন।
দ্বীপটির প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এখানে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হয়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভাঙায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় স্বল্প আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি।
শত বছরের কুতুবদিয়ার মানুষের জীবনযাত্রার মান সমৃদ্ধ হলেও, বিদ্যুৎ না থাকায় সামগ্রিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিল। স্বাধীনতার ৫ দশক পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষের কথা ভাবেনি কোনও সরকার। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনমান বদলে গেছে। সর্বক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
বিদ্যুৎ কুতুবদিয়ার মানুষের কাছে এক সময় স্বপ্ন ছিল।

জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে উঠা কুতুবদিয়ার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়িসহ বড়ঘোপ বাজার। কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ বাজারে ব্যবসায়ী জিল্লুর করিম জানান, কুতুবদিয়া বিদ্যুৎ আসবে এটা অকল্পনীয় ছিল। কুতুবদিয়ার মানুষের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ছিলেন। ১২ এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। আমি মনে করি, বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের মতো এখানে শিল্প- কারখানা গড়ে উঠবে।
কুতুবদিয়া বড়ঘোপ বাজার কলেজের মুদি দোকানের ব্যবসা করেন মো. আজিজ মিয়া। তিনি চাল, চাল, আটা,ময়দারসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করে আসছে। দীর্ঘদিন ডিপ ফ্রিজে ৬ ঘন্টা ঠান্ডা করে কোমলপানীয় বিক্রি করলেও কোনো দিন আইসক্রিম বিক্রি করেননি এই ব্যবসায়ীসহ অত্র উপজেলা ব্যবসায়ীরা। কারো প্রয়োজন হলে কক্সবাজারে সমুদ্রের চ্যানেল পার হয়ে খেতে হতো। বর্তমান সরকার সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে দ্বীপ কুতুবদিয়া। এতে আজিজের মতো মুদি ব্যবসায়ীর কপাল খুলেছে।
মো. আজিজ বলেন, গত তিন মাস ধরে আইসক্রিম বিক্রি করছি। বিদ্যুৎ আসার সাথে সাথে সেবয় আইসক্রিম কোম্পানি আমাদেরকে ফ্রিজ দেয়। যে দিন প্রথম আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেছি, সে দিন ১৭ হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি করেছি। এখন দৈনিক ৭/৮ হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হয়।
তিনি আরো বলেন, আগে জেনারেটরের কারেন্ট দিয়ে ডিপ ফ্রিজে স্পিড, টাইগার, কোকাকোলা, সেভেন আপ বিক্রি করতাম। কারণ, ৬ঘন্টা কারেন্ট ছিল। সন্ধ্যা ৬টা দিলে রাত ১১টা কিংবা ১২ টা পর্যন্ত থাকতো। এখন ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে। আইসক্রিম বিক্রিতেই আমাদের ভাগ্য ঘুরেছে।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের চান্দের গাড়ীর ড্রাইভার নুরুল কালাম (৪১) বলেন, ৬ মাস ধরে বিদ্যুত এসেছে। আমার ঘরে বিদ্যুৎ যায়নি। তবে বৈদ্যুতিক খুটি দেওয়া হয়েছে। আমার ঘরে বৈদ্যুতিক তার লাগানো হয়েছে। এতো দিন সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে লাইট জ্বলতো।
তিনি আরও বলেন, আমার বাপ দাদারা এখানে ছিল। বিশ বছর আগে সৌর বিদ্যুৎ আসছিল। আর বিদ্যুৎ আসবে কেউ ভাবতেও পারিনি। ২০১৪ সাল থেকে শুনতেছি আসবে আসবে, শেষ মেষ আমাদের ঘরেও মিট মিট আলো থেকে জ্বল জ্বল আলো জ্বলবে।

কুতুবদিয়ার মনোয়াখালী গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলম বলেন, আমাদের গ্রামে তিন মাস হলো বিদ্যুৎ এসেছে। অনেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ না লাইন লাগানো হচ্ছে। আগে তেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চাজ দিতাম। তেল না থাকলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সৌরবিদ্যুত দিয়ে মোবাইল চার্জ দিতাম। এখন আমার ঘরে বিদ্যুৎ আছে।
আরস সিকদার পাড়ার বজল করিম (৬৪) বলেন, আগে আমার বাড়িতে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। মাসখানেক আগে আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। আমি মিটারের জন্য আবেদনের এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পেয়েছি। সোলার দিয়ে লাইট জ্বালাইতাম। এখন আমার বাড়িতে রাইসকুকার দিয়ে ভাত রান্না হয়। ফ্রিজ কিনেছি। সমুদ্রের মাছ রেখো খেতে পারি।

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরে চকরিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বৌর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও কুতুবদিয়ার আবাসিক প্রকল্প দপ্তরের প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল হক বলেন, "কুতুবদিয়ায় অতিদ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যই এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে, এর আগে এই এলাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে দিনে চার পাঁচ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো, সন্ধা ছয়টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা করা হতো। এখন ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন আমাদের তিন হাজার গ্রাহক আছে, আরও সাতশত আবেদন করেছে। ৫-৬ মাসের মধ্যে ছয়টি ইউনিয়নেই দাতে পারবো। তবে ক্রমান্বয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
কুতুবদিয়ার অর্থনীতি ও সমাজিক উন্নয়নের কথা ধরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপঙ্কর তাংচংগা বলেন, এই এলাকার মানুষের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। যেটা স্বাধীনতার পর থেকে ছিলো না। এখানে এখন দুইটি ফ্রিজের দোকান হয়ে গেছে, জমির দাম বেড়ে গেছে। ক্ষুদ্র শিল্প করার দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মৎস শিল্প ও বরফ শিল্পের অনুমোদনেরর জন্য যোগাযোগ করছে এখানকার লোকজন।
আমাদের কাগজ/টিআর/এমএসআই






















