আড়াইহাজার প্রতিনিধি
রাত হলেই বাড়ে আতঙ্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মসজিদের মাইকে আসে ঘোষণা ‘ডাকাত ঢুকেছে’। দলে দলে মানুষ লাঠি নিয়ে নামেন পাহারায়। ভোর পর্যন্ত কাটে রুদ্ধশ্বাসে। এমন দৃশ্য এখন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের গ্রামে গ্রামে। গত ১৫ দিনে এ এলাকায় অন্তত ১২ ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়নি। ভুক্তভোগীরা জানান, মামলা করলে কিছুই হয় না। তাই কেউ মামলা করতে চায় না। তবে থানার ওসির দাবি, চিহ্নিত ডাকাতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ডাকাতি কমে আসছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে হাইজাদী ইউনিয়নের কাহিন্দী এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা ডাকাত সন্দেহে পিটুনি দিয়ে বিল্লাল হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। তাঁর বিরুদ্ধে ৮টি খুন ও ডাকাতির মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানায়।
একই দিন রাত দেড়টার দিকে আড়াইহাজার পালপাড়া এলাকার কাজী আবুল হোসেনের বাড়িতে ১০-১৫ জনের ডাকাত দল হানা দেয়। তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে ১৫ লাখ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুটে নেয়। গত মঙ্গলবার কড়ইতলা তালতলা গ্রামের প্রবাসী আলমগীর হোসেনের বাড়িতে রাত দেড়টার দিকে ১০-১৫ জন মুখোশ পরা ডাকাত দল দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। অস্ত্রের মুখে পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে ২০ হাজার টাকা, ২ ভরি স্বর্ণালংকার, ১০ ভরি রুপা, ৩টি মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয়। ওই রাতে ২টার দিকে একই গ্রামের পাওয়ারলুম শ্রমিক সাইফুল ইসলামের বাড়িতে ডাকাত দল হানা দেয়। দরজা ভেঙে ঢুকে মেহমানসহ একটি শিশুকে জিম্মি করে আড়াই লাখ টাকা, ৪ ভরি স্বর্ণালংকার, ১০ ভরি রুপা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান মালপত্র লুটে নেয় তারা। একই সময়ে নরিংদী গ্রামের ব্যবসায়ী সুমন মিয়ার বাড়িতে হানা দিয়ে ১৫ হাজার টাকা, ২ ভরি স্বর্ণালংকার ও দুটি মোবাইল ফোন লুট করে এক দল ডাকাত।
২১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৩টার দিকে আড়াইহাজার পৌরবাজারে পাহারাদারের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে ডাকাত দল। এরপর তারা তালা কেটে বাজারে লিটন ট্রেডার্স নামে মুদি দোকানের ড্রয়ার ভেঙে ৩ লাখ টাকা, শাজাহান স্টোরের ড্রয়ার ভেঙে ২ লাখ, মেসার্স পোলট্রি ফিডের ড্রয়ার ভেঙে ৫ লাখ এবং মাহমুদুল হাসানের রাজধানী টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্সের ড্রয়ার ভেঙে ৫০ হাজার টাকা লুটে নেয়।
মেসার্স পোলট্রি ফিডের আল আমিন মিয়া জানান, শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকায় দোকানে বাজারের ব্যবসায়ীরা নগদ টাকা দোকানের সিন্দুক কিংবা ড্রয়ারে রেখে যান। তিনিসহ ভুক্তভোগী দোকানদাররা পুলিশের টহল তেমন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৩টার দিকে গোপালদী পৌরসভার রামচন্দ্রদী দক্ষিণপাড়ার কৃষক আব্দুল হালিমের বাড়ি থেকে ডাকাত দল দেড় ভরি স্বর্ণালংকার, ৭ ভরি রুপা, ৭ হাজার টাকা, ৪টি মোবাইল ফোনসহ প্রায় দুই লাখ টাকার মালপত্র লুটে নেয়। ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর আক্রান্তদের চিৎকারে প্রতিবেশীরা এসে আহত আব্দুল হালিম, তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার ও মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। ওই রাতে আড়াইটার দিকে রামচন্দ্রদী উত্তরপাড়ায় মো. ইব্রাহিম ও বেলায়েত হোসেনের বাড়িতে ১০-১২ জন ডাকাত ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে আধা ভরি স্বর্ণালংকার, ৪০ হাজার টাকা, ৫টি মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান আসবাব লুটে নেয়।
২৬ ডিসেম্বর রাতে ছিনতাই করা রড ভর্তি একটি ট্রাক বিশনন্দী ফেরিঘাটে টহল পুলিশ জব্দ করে। এ সময় আব্দুর রহমান (২৪), আহাদ মিয়া (২৫), চঞ্চল মিয়া (২৭) ও রাব্বী মিয়া (২৩) নামে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২২ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে ঝিনাইদহ থেকে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ফাহিমা ই ট্রান্সপোর্টের একটি ট্রাক ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আড়াইহাজার উপজেলার বান্টি বাজার ও ছনপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছালে ডাকাত দল প্রায় ১৫ টন ওজনের চিনিসহ ট্রাকটি নিয়ে যায়। তারা চালক ও তাঁর সহযোগীকে চেতনানাশক দিয়ে অচেতন অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। পরদিন বিষয়টি মেঘনা গ্রুপের পক্ষ থেকে আড়াইহাজার থানা পুলিশকে জানালে আশুলিয়া এলাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৫৪ বস্তা চিনিসহ ট্রাকটি জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হয় বেশ কয়েকজন।
১৮ ডিসেম্বর ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশে পুরিন্দা ডিজিটাল প্রিন্টিং মেশিনে কাজ করতে যাওয়ার সময় মহাসড়কের বারো আউলিয়া দুধের ফ্যাক্টরি এলাকায় পৌঁছালে ৭-৮ জন নাঈম ইসলামকে মারধর করে মোবাইল ফোনসহ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ১৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৩টার দিকে নরসিংদী-মদনগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার মারুয়াদি এলাকায় এক দল ছিনতাইকারী কলা গাছ ফেলে একটি ট্রাকের গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে চালক ও তাঁর সহযোগীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ও ২টি মোবাইল ফোন লুটে নেয়।
বিনাইরচর গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, ডাকাতদের কবল থেকে নিজেদের জানমাল রক্ষা করতে প্রতিদিন তাদের মহল্লায় অন্তত ১০ জনের একটি দল গঠন করা হয়েছে। তারা রাত জেগে পাহারা দিয়ে থাকেন। এ সময় তারা লাঠি, হকিস্টিক সঙ্গে রাখেন। সঙ্গে থাকে টর্চলাইট। পাহারা দেওয়ার সময় প্রায়ই খিচুরি, বিরিয়ানিসহ নানা ভোজেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে।
ওসি এনায়েত বলেন, গত এক সপ্তাহে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সর্দার আটটি ডাকাতি মামলার আসামি সজল চন্দ্র দাসসহ বেশ কয়েকজন ডাকাত ও ছিনতাইকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। চিহ্নিত ডাকাতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের অভিযান চলছে। খবর পেয়েই ব্যবস্থা নেওয়ায় ডাকাতি কমে আসছে। শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।





















