উপজেলা প্রতিনিধি
বেনাপোল বন্দরে ভুয়া মেনিফেস্টের (মিথ্যা তথ্য দেওয়া) মালামাল আমদানি বন্ধ হচ্ছে না। বন্দরে প্রায় কোটি টাকার অবৈধ মালামাল জব্দ হলেও চক্রের মূলহোতারা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাস্টমস কর্তাদের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
সবশেষে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারত থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা একটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়। ভারতীয় কাভার্ডভ্যানটি বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্গো ইয়ার্ডে প্রবেশ করে। এরপর স্কেল হয়ে কার্গো ইয়ার্ডের মধ্যে এসে হেলপার ও চালক দ্রুত নিজের দেশে চলে যায়। এরপর গাড়িটি বন্দরের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংস্থা পিমার নিরাপত্তা কর্মীরা পাহারা দিচ্ছে।
জব্দ কাভার্ডভ্যানে কি আছে সেটি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দেখেননি। পরে কাস্টমস হাউসের তত্ত্বাবধায়নে ট্রাকটি সিলগালা করে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে ট্রাকটি বেনাপোল কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনালে পাহারায় রয়েছে। কাস্টমসের রহস্যজনক এ ভূমিকার কারণে বেনাপোল বন্দরে ব্যবসায়ীদের মাঝে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বন্দরের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংস্থা পিমার নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, কাভার্ডভ্যানটি কারা জব্দ করেছে এবং এ গাড়িতে কাদের মালামাল রয়েছে জানি না। বন্দরের স্যাররা গাড়িটি পাহারা দিতে বলেছেন। শুনেছি গাড়িচালক ও হেলপার পালিয়ে গেছেন।
তবে গোপন সূত্রে জানা গেছে, ট্রাকটিতে ভারত থেকে বডি স্প্রের আড়ালে উচ্চ শুল্কযুক্ত উন্নতমানের ফেব্রিক্সের চালান আনা হচ্ছিল। যে কারণে বেনাপোল কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনালে ট্রাক রেখে ড্রাইভার পালিয়ে যান। এ পণ্য চালানের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল রাইচ ট্রেডিং ইন্টারন্যশনাল এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল বিলিসিভ কসমেটিক্স লিমিটেড।
বন্দরের একটি সূত্র জানায়, চোরাচালানি ও পাচার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারতীয় ট্রাকের আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে আসে বিপুল পরিমাণ অবৈধ পণ্য। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য এভাবে ভারত থেকে পাচার করে আনা হচ্ছে। এ চক্রের দৌরাত্ম্যর কারণে সরকার কোটি কোটি টাকা শুল্ক হারাচ্ছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য নিয়ে আসার কারণে বেনাপোল কাস্টমস হাউজ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
ব্যবসায়ী মহল বলছে, প্রতিবার কিছু ট্রাকচালক ধরা পড়ছে। কিন্তু এর পেছনের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য গ্রেফতার হচ্ছেন না। এছাড়াও বেনাপোল বন্দর ও কাস্টমস হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্থানীয় একটি চোরাচালান চক্র কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভুয়া মেনিফেস্ট আর নো-এন্ট্রি পণ্য আমদানি বন্ধ হবে না।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান স্বজন বলেন, বেনাপোলে অবৈধ পণ্য জব্দ তৎপরতায় দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের গাফিলতি এখানে দৃশ্যমান। উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশাসন দ্বারা বেনাপোল বন্দর পরিচালনা করা না গেলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি চলতে থাকবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আমদানিকারক বলেন, প্রায়ই ভুয়া মেনিফেস্ট ও নো-এন্ট্রি পণ্য জব্দ হচ্ছে। এতে বৈধ ব্যবসায়ীরা বারবার সমস্যায় পড়ছেন। ইতোপূর্বে ভুয়া মেনিফেস্টের মাধ্যমে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু বেনাপোল বন্দর ও কাস্টমসের কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ অবস্থা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, গোপন একটি তথ্যের ভিত্তিতে গাড়িটি মঙ্গলবার রাতে জব্দ করি। গাড়িটি দেখার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। গাড়ি জব্দের সময় দ্রুত ওই গাড়ির চালক ও হেলপার পালিয়ে যান। তবে এখনো গাড়িটি আমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। কাস্টমস যখন চাইবে তখন যাচাই-বাছাই করে কী পণ্য আছে সেটি জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, বন্দরে নানা অনিয়মের কারণে বন্দর সংশ্লিষ্ট ১৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বন্দরে প্রতিটি ঘটনায় আমাদের নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মালামাল তল্লাশি ও সন্দেহভাজন চিহ্নিত করার কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। আমরা শুধু আটক অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকছি না, মূলহোতাদের ধরার জন্য সিসিটিভি মনিটরিং, রিস্ক প্রোফাইলিং ও সমন্বিত টিম কার্যক্রমে মনোযোগ দিচ্ছি। তবে সিন্ডিকেটের জটিলতার কারণে কিছু ঘটনা আমাদের চোখের আড়াল হতে পারে।
এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর রাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বন্দরের বাইপাস সড়কে অভিযান চালিয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস, কসমেটিকস, ওষুধ ও মোটরসাইকেলের টায়ার জব্দ করে। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হলেও মূল কারবারিদের চিহ্নিত করা যায়নি।






















