নিজস্ব প্রতিবেদক
দীর্ঘ আন্দোলন, সংঘর্ষ, আলোচনা ও পর্যালোচনার নানা ধাপ পেরিয়ে অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে যাত্রা শুরু করছে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঘিরে গঠিত নতুন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়—‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু থাকবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠদান। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে চারটি অনুষদের অধীনে ২৩টি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে।
ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ—এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত কাঠামোর ভিত্তিতে গড়ে উঠছে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রস্তাবিত এই বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে শিগগিরই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আপাতত ভর্তিপরীক্ষা ও প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রস্তাবনা এসেছে। এটি হবে মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের অব্যবহৃত ২৫ একর জমিতে।
শুরুতেই চারটি অনুষদ, হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে চারটি প্রধান স্কুল বা অনুষদ—সায়েন্স, আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, বিজনেস স্টাডিজ এবং ল অ্যান্ড জাস্টিস। আর শিক্ষা কার্যক্রম হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে—৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে এবং ৬০ শতাংশ অফলাইনে। তবে সব পরীক্ষা সশরীরে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। প্রথম চার সেমিস্টারে থাকবে নন-মেজর বিষয়, পরবর্তী চার সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা পড়বেন মেজর ডিসিপ্লিনে। পঞ্চম সেমিস্টারে শর্তসাপেক্ষে ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে, তবে কলেজ পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রতি বিষয়ে ভর্তি হবে সর্বোচ্চ ৪০ জন
স্নাতক পর্যায়ের ২৩টি বিষয়ের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। সাতটি কলেজের মধ্যে পাঁচটিতে একাদশ শ্রেণির পাঠদান আগেও ছিল, এবার ইডেন ও সরকারি তিতুমীর কলেজও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠদান শুরুর প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ধারাও যুক্ত হলো। উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতকের শিক্ষার্থীরা টাইম, স্পেস ও রিসোর্স শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে একই ক্যাম্পাস ব্যবহার করবেন।
প্রশাসনিক কাঠামো ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে থাকবেন একজন উপাচার্য (ভিসি), দুইজন প্রো-ভিসি (একাডেমিক ও প্রশাসনিক), একজন কোষাধ্যক্ষ ও ১৫ সদস্যের প্রক্টরিয়াল বডি। আর সাত কলেজের প্রতিটিতেই একজন করে নারী ও পুরুষ ডেপুটি প্রক্টর থাকবেন। শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক নিয়ন্ত্রণে থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো।
এই চুক্তির ধরন বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে দেখা যায়নি, ফলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববণ্টনের নতুন মডেল হতে পারে এটি।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হবে চারটি ধাপে। প্রথম ধাপে অধ্যাদেশ জারি করে আইন কার্যকর, দ্বিতীয় ধাপে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি, তৃতীয় ধাপে উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কাঠামো গঠন এবং চতুর্থ ধাপে শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
কোথায় কী বিষয় পড়ানো হবে?
প্রস্তাবনা অনুযায়ী ঢাকা কলেজে গণিত, পরিসংখ্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ডাটা সায়েন্স, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি ও রসায়ন বিভাগের পাঠদান করার সুপারিশ করা হয়েছে। ইডেন কলেজে পদার্থবিজ্ঞান, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ফরেস্ট্রি সায়েন্স পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বদরুন্নেসা কলেজে আরবান অ্যান্ড রুরাল প্ল্যানিং এবং এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারি তিতুমীর কলেজে অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, এইচআর, হোটেল অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ও ব্যাংক অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিষয়ে পাঠদান করার সুপারিশ করা হয়েছে। আর সরকারি বাঙলা কলেজে জার্নালিজম, ফটো অ্যান্ড ভিডিওগ্রাফি, অ্যাপ্লাইড সোশিওলজি, পলিটিক্যাল ইকোনমি, ইকোনমিক্স এবং ডিপ্লোম্যাটিক স্টাডিজ এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে যৌথভাবে ‘ল অ্যান্ড জাস্টিস’ বিভাগে পাঠদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে নারী শিক্ষার্থীদের কলেজে পুরুষ ও ছেলে শিক্ষার্থীদের কলেজে নারীদের ভর্তির বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
তবে কলেজগুলোর স্বতন্ত্র পরিচয় ও অবস্থা বজায় থাকার বিষয়টিই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের অন্তর্বর্তী প্রশাসক অধ্যাপক একেএম ইলিয়াস। তিনি বলেন, আমরা চাই কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকুক। যেমন ঢাকা কলেজ শুধু ছেলেদের আর ইডেন ও বদরুন্নেসা শুধু মেয়েদের জন্য। এগুলো যেন মিলে না যায়।
এবছর কারা ভর্তির সুযোগ পাবেন?
রোববার (৩ আগস্ট) ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি আবেদনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এবার ১১ হাজার ১৫০ আসন নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের অধীনে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি আবেদনও শুরু হয়েছে। অনলাইনে আবেদন করা যাবে ১০ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত। আর আবেদন বাতিল ও তথ্য–ছবি সংশোধনের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ আগস্ট।
জানা গেছে, ইডেন ও বদরুন্নেসায় শুধু ছাত্রী, আর ঢাকা কলেজে শুধু ছাত্র ভর্তির সুযোগ পাবে। বাকি চার কলেজে ছাত্রী–ছাত্র উভয়েই ভর্তি হতে পারবেন। ইতোমধ্যে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে প্রাথমিক আবেদন করেছেন, তাদের পুনরায় আবেদন করতে হবে না; আগের আবেদনই ডিসিইউ আবেদন হিসেবে গণ্য হবে।
কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হবে ২২ আগস্ট (শুক্রবার) বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। এমসিকিউ পদ্ধতির ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান—তিন বিষয়ে ১০০টি প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটি ভুল উত্তরে ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। আর পাস নম্বর ৪০। বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুকদের ওই বিষয়েই অন্তত ১০ নম্বর পেতে হবে।
আর বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হবে ২৩ আগস্ট (শনিবার) বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। ভর্তি পরীক্ষা এমসিকিউ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ২০২৪ সনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুসৃত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী হবে এবং প্রত্যেক প্রার্থীকে পদার্থ ও রসায়নসহ মোট চারটি বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রতি বিষয়ের জন্য মোট নম্বর ২৫। আর ১০০টি প্রশ্নের জন্য মোট নম্বর হবে ১০০। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ নম্বর ন্যূনতম ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ৪০ নম্বরের কম পেলে কেউ ভর্তি হতে পারবেন না।
এছাড়া বাণিজ্য ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাও ওই একইদিন বিকেল ৩টা থেকে ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আবেদন ফি ধরা হয়েছে ৮০০ টাকা। সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের যেকোনো শাখা কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ও বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে প্রবেশপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে হবে।
ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মেধাক্রম তৈরি হবে মোট ১২০ নম্বরের ওপর— এসএসসির ১০ নম্বর, এইচএসসি ১০ নম্বর এবং পরীক্ষার ১০০ নম্বর যোগ করে। কলেজ ও বিষয় পছন্দক্রম অনলাইনে দিতে হবে, আর ২০ অক্টোবর বিষয় বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে। ভর্তি শেষ তারিখ ২৫ অক্টোবর এবং ক্লাস শুরু হবে ৩০ অক্টোবর।
একইসঙ্গে কোটায় ভর্তি-ইচ্ছুদের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, হরিজন-দলিত, ক্রীড়াবিদ, ওয়ার্ড এবং হিজড়া) অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর পেতে হবে এবং সাত দিনের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে বলেও জানানো হয়েছে।





















