জাতীয় ১ আগস্ট, ২০১৯ ০৪:৪২

তরল দুধে ক্ষতিকারক ধাতু নেইঃ কৃষিমন্ত্রী

দেশে উৎপাদিত তরল দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক মাত্রায় ভারী ধাতু, সালফা ড্রাগ ও অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব নেই। এসব পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত তরল দুধ খেলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে মিল্ক ভিটার পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে স্টেপটোমাইসিন ও প্রাণ ডেইরির দুধে ক্লোরাফেনিকল পাওয়া গেলেও, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার নিচে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। 

সচিবালয়ে বুধবার দুপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পুষ্টি ইউনিটের করা পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে কৃষিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তাঁর মতে, সম্প্রতি দুধের মধ্যে ভারী ক্ষতিকর ধাতুর অস্তিত্বের যে খবর ছড়িয়েছে, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। তাই তরল দুধ খাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিএআরসির পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন।

সম্প্রতি পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধ উৎপাদন করা ১৪ কোম্পানির পণ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, ভারী ধাতু ও সালফার ড্রাগ রয়েছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে ওই সব কোম্পানির দুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় বিএআরসি। বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিএআরসির গবেষণার ফলাফলে পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে কোনো ধরনের ভারী ধাতু যেমন লিড ও ক্রোমিয়ামের রেসিডিউ (অবশিষ্টাংশ) পাওয়া যায়নি। ফলাফলে পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে কোনো ধরনের সালফা ড্রাগের অবশিষ্টাংশও পাওয়া যায়নি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মোট ১৬টি নমুনার মধ্যে শুধু একটি নমুনায় (মিল্ক ভিটা) অ্যান্টিবায়োটিক স্টেপটোমাইসিনের উপস্থিতি প্রতি কেজিতে ১০ মাইক্রোগ্রামের নিচে পাওয়া গেছে। তবে তা মানবদেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে (সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা কেজিতে ২০০ মাইক্রোগ্রাম)।

অন্যদিকে প্রাণ ডেইরির দুধের একটি নমুনায় ক্লোরাফেনিকলের উপস্থিতি প্রতি কেজিতে ০ দশমিক ০৬ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। দুধের ক্ষেত্রে এটির কোনো নির্ধারিত মাত্রা পাওয়া যায়নি, তবে কারও কারও মতে ০ দশমিক ১ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া বিশ্লেষণ করা (১০টি) নমুনায় অন্য কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি বা অবশিষ্টাংশের অস্তিত্ব মেলেনি। 

বিএআরসির পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, গবেষণালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বাজারজাত করা দুধ পানে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। তিনি বলেন, খাদ্যবিষয়ক যেকোনো ধরনের আতঙ্ক বা বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা এবং একদল প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি জরুরি। বাজারে অনেক দুধ থাকলেও সাত কোম্পানির নমুনা সংগ্রহ বিষয়ে মনিরুল বলেন, ‘আমরা গুরুত্ব দিয়েছি যে সমস্ত কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা খুব বেশি এবং দেশে খুব বেশি প্রচলিত, সেগুলো তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করার ওপর।’ তিনি জানান, পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে কোনো ধরনের ভারী ধাতু ও সালফা ড্রাগ পাওয়া যায়নি। 

খাদ্যপণ্যের গুণগত মান বিশ্লেষণে এ দেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো ল্যাবরেটরি নেই, জানিয়ে মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, স্থানীয় এসব গবেষণাগারের বিশ্লেষণ সক্ষমতা বা মান কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এক শ্রেণির সুবিধাভোগী ব্যক্তি কোনো ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বা কোনো ধরনের মানসম্পন্ন গবেষণা ফলাফল ছাড়াই অনেকটা দায়সারা প্রতিবেদন তৈরি করে বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে চলেছে।

বিএআরসির পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক জানান, বিগত বছরগুলোতেও এসব ফল, সবজি, মাছসহ খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন প্রয়োগ করা হয় বলে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানো হয়েছে। ফলে মানুষ শুধু ফল খাওয়াই ছেড়ে দেয়নি, এতে আর্থিক ক্ষতিসহ বৈদেশিক বাজারেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। জনমনের অস্থিরতা দূর করতে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, সালফা ড্রাগ ও ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য বিএআরসি দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাজারজাত করা পাস্তুরিত দুধসহ কাঁচা তরল দুধ সংগ্রহ করে। এসব নমুনায় কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, সালফা ড্রাগ ও ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকার মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গুলশান ও ফার্মগেট এলাকা থেকে পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের নমুনা সাভারের রাজাসনের খামার থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের নমুনা সরাসরি বিশ্লেষণসহ একই সঙ্গে এসব দুধের প্রতিটি নমুনা ৯ মিনিট সিদ্ধ করে অ্যান্টিবায়োটিক, সালফা ড্রাগ ও ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের উপস্থিতিও বিশ্লেষণ করা হয়। বুধবারের সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। এ সময় বিএআরসির চেয়ারম্যান কবির ইকরামুল হকসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এই সাত ধরনের দুধ খেলে মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না, যদি ক্ষতি হয় সে দায় আপনারা নেবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারা দেশে দুধের উৎপাদন হয়। অনেক শিল্প এলাকা, শহর এলাকাতেও গাভি পালন করা হয়। এখন হঠাৎ কোথাও যদি ভারী ধাতু হয়ে থাকে, আমরা পরীক্ষা করিয়েছি সেগুলো খুব নির্ভরযোগ্য। এটার ভিত্তিতে আমরা বলছি এগুলোতে আমরা পাইনি। ১৬ জুলাই নমুনা পাঠানো হয়েছিল, আমরা মনে করি এসজিএসের রিপোর্টটা রিলায়েবল এবং সারা পৃথিবীর জন্য এটি গ্রহণযোগ্য। সিঙ্গাপুরে করালেও একই হতো। ১৩০টি দেশে এসজিএসের ল্যাবরেটরি আছে।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেসব দুধের পরীক্ষা করিয়েছি সেগুলো অবশ্যই নিরাপদ এবং কোনো রকম সমস্যা নেই। আর ছোট ছোট যে কোম্পানি আছে, আমার ধারণা তারাও হয়তো ভালোই হবে। তবুও এগুলো পরীক্ষার দাবি রাখে। আগামীতে আমরা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠাব।’

উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন ঢাবির ফার্মাসি অনুষদের শিক্ষকেরা একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। মিল্ক ভিটাসহ সাতটি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধের নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সব কটিতেই লেভোফ্লক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও ছয়টি নমুনায় এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, যেসব ল্যাবরেটরির কথা বলা হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগেরই ভারী ধাতু, অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট পরীক্ষা করার সক্ষমতা নেই। এসব বিষয় মাথায় রেখে সাভারে একটি পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরলে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করব, আমার গবেষণা প্রতিবেদন দেখাব। এরপর আমরা আমাদের বক্তব্যে দেব।’

সূত্রঃ প্রথম আলো