নিজস্ব প্রতিবেদক
পদ শূন্য হওয়ার দুই মাস পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই পদে যোগ্য ব্যক্তির নাম খুঁজতে শিগগিরই সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে। কমিটির প্রধান হচ্ছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। একই সঙ্গে কমিটির সদস্য হিসেবে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানকে মনোনীত করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী ছয় সদস্যের সার্চ কমিটিতে দুই বিচারপতির সঙ্গে থাকছেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই বিশিষ্ট নাগরিক। তারা হলেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সি আর আবরার। এ ছাড়া পদাধিকারবলে অন্য দুই সদস্য হলেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম। সরকারি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জোর দাবি ছিল ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ’ ঘোষণার। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ইসি গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সরকারের এ প্রক্রিয়া বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে; আবার কেউ বলছে, প্রায় দুই মাস আগে পদগুলো শূন্য হয়েছে। এ উদ্যোগ আগেই নেওয়া যেত। নির্বাচনের সময় নিয়ে জনমনে স্বস্তি আনতে রোডম্যাপ ঘোষণার বিকল্প নেই।
সরকার গঠিত এই সার্চ কমিটি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দু’জন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
শুরুতে আইন সংস্কারে ব্যাপক উদ্যোগের কথা বলা হলেও বিদ্যমান আইনেই গঠন হতে যাচ্ছে নতুন কমিশন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন গত ৫ সেপ্টেম্বর একযোগে পদত্যাগ করে। এর পর থেকে সাংবিধানিক এই পদগুলো শূন্য রয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা রয়েছে। আগামী ৪ নভেম্বর সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না হলে কী হবে– সে বিষয়ে সংবিধানে কোনো নির্দেশনা নেই। যদিও বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগের আগে সমকালে নিবন্ধ লিখে এই সংকটের জন্য কারও পরামর্শ পাননি বলে উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি এ বিষয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন বলেও ওই নিবন্ধে দাবি করেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ৬ আগস্ট দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। এ পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়ে দেশ। এরপর ৮ আগস্ট আদালতের পরামর্শে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সংস্কার কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ আসতে থাকে। বিএনপির তরফ থেকে সরকারের সঙ্গে সংলাপে একাধিকবার এ বিষয়ে দাবি তোলা হয়। অন্যদিকে, জামায়াতের পক্ষ থেকে নির্বাচনী পথনকশার পাশাপাশি সংস্কার কাজেরও রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়। তবে সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো সময় ঘোষণা করেনি। এমনকি কখন নির্বাচন হতে পারে– এমন ধারণা দেওয়া থেকেও তারা সচেতনভাবে বিরত। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কারের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরার মতো পরিস্থিতি হলেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।
এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকার ও ছাত্রনেতারা এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও বিএনপিসহ সমমনা দল সাংবিধানিক সংকটের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। এ পরিস্থিতিতেই নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত সার্চ কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংস্কার কমিটির সুপারিশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা করা যায়। নতুন ইসি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সংস্কার কমিটির কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। তিনি বলেন, এসব সুপারিশের মধ্যে কিছু বাস্তবায়ন করবে সরকার, আবার কিছু বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন কমিশন।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিটির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। সেই আলোকেই নির্বাচনী আইনগুলোর সংস্কারে সুপারিশ করা হবে। তবে নতুন কমিশন গঠনে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশ্যা পূরণ হবে কিনা– এমন প্রশ্নে জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সার্চ কমিটি গঠনের আইনি প্রক্রিয়া
বিদ্যমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ’ আইন, ২০২২ অনুযায়ী শূন্য পদে নিয়োগ দিতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করার বিধান রয়েছে। এ কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক, যাদের একজন হবেন নারী। আনুষ্ঠানিকতার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। সার্চ কমিটি দায়িত্ব পাওয়ার ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাব করবে।
নির্বাচনের পথে যাত্রা: আইন উপদেষ্টা
এর আগে ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে দুয়েক দিনের মধ্যে সার্চ কমিটি চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি গঠন হয়ে গেছে। যতটুকু জানি, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় সিগনেচার করে দিলেই, হয়তো করেছেনও, আজকালের মধ্যে জেনে যাবেন।’ নির্বাচন দিতে কত সময় লাগবে, তা অনেক ‘ফ্যাক্টরের’ (বিষয়ের) ওপর নির্ভর করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। সার্চ কমিটি হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। এর পর ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ অন্যান্য কাজ।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইসির সব কমিশনার অনেকদিন আগে পদত্যাগ করেছেন। ফলে এই সার্চ কমিটি অনেক আগে গঠন করা সম্ভব ছিল। একই সঙ্গে নির্বাচনের অন্য প্রস্তুতিও নেওয়া যেত। তিনি বলেন, এখনও সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সরকার যদি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে, তাহলে দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট, তারা নির্বাচনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তবে সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা করলে ভালো হতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরত। একটা নিশ্চয়তা আসত। এই সরকারকে নির্বাচন তো দিতেই হবে। সেটা ছয় মাস আগে কিংবা ছয় মাস পরে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তাদের অগ্রগতি ও সার্চ কমিটি গঠনে তিনি আশাবাদী। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা আসবে।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরুর কথা বললেও বাস্তবে এ বিষয়ে তাদের তেমন কোনো যাত্রা তো দেখছি না। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত সরকারের যতটুকু কার্যক্রম, তাতে তাদের প্রতি জনগণের আস্থার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সরকার যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, সেটাতেও জনগণ সম্পৃক্ত হতে পারছে না। ফলে এসব প্রশ্নে সরকারকে প্রথমেই জনগণের আস্থা অর্জনের বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। এর পর নির্বাচন বলুন, সংস্কার বলুন– সরকারের যে কোনো কার্যক্রমে জনগণেরও সমর্থন থাকবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে জনমনে সৃষ্ট সংশয় পুরোপুরি কাটবে বলে তিনি মনে করেন না। তার পরও এই সার্চ কমিটি গঠন একটা ইতিবাচক ও ভালো উদ্যোগ। তবে এই সার্চ কমিটি গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত ছিল।
এই আইনের অধীনে ২০২২ সালের নির্বাচন কমিশনই প্রথম নিয়োগ পেয়েছিল। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। সেই কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। আর কমিশনার হিসেবে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এক মাসের মাথায় ৫ সেপ্টেম্বর বিদায় নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন, যাদের অধীনে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল।