জাতীয় ১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ১০:২২

সিলেটের রেলপথ যেন পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে

ডেস্ক রিপোর্ট ।। 

নিরাপদ ভ্রমণ বলতে রেলকেই বোঝানো। বর্তমান সময়ে সেই নিরাপদ রুট হয়েছে এক আতঙ্কের নাম। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় রেলের ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলছেন সাধারণ মানুষ।

বিশেষ করে রেলের সিলেট রুট হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ।

সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে প্রতিদিন চলাচল করে একাধিক ট্রেন। উদয়ন, পাহাড়িকা, জয়ন্তিকা, উপবন, কালনী, জালালাবাদ প্রভৃতি এক্সপ্রেস ট্রেন চলে এসব রুটে।

জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলে রেল যোগাযোগ চালু হয় ব্রিটিশ আমলে। ওই সময়ে রেলের জন্য যে লাইন নির্মাণ করা হয়, তাতে ভর দিয়েই এখনও চলছে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ। কিন্তু এ রেলপথে বড় আকারের সংস্কার হয়েছে খুব কম সময়ই। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সংস্কারের আওয়াজ আসে। কিন্তু পরবর্তীতে এ আওয়াজ স্থিমিত হয়ে যায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলের সিলেট রুটে অনেক স্থানেই স্লিপারের নাট-বল্টু নেই, হুক ও ফিশপ্লেট নেই। অনেক স্থানে রেলপথে যে পরিমাণ পাথর থাকার কথা, সে পরিমাণে নেই। রেলপথের অনেক স্থানেই ঢিলে হয়ে গেছে স্লিপারের নাট-বল্টু; পচে গেছে কাঠের পাটাতন। এছাড়া সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের থাকা বেশ কয়েকটি সেতুর অবস্থাও নড়বড়ে। ফলে দুর্ঘটনা এখন যেন ধারাবাহিক ঘটনা হয়ে পড়েছে!

সর্বশেষ সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট থেকে উদয়ন চট্টগ্রামে যাচ্ছিল, অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল তূর্ণা। এ সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন বহু মানুষ।

পরিসংখ্যান বলছে, গত ৯ মাসে রেলের সিলেট রুটে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ২০ জন মানুষ। এই সময়ে দেশের অন্য কোনো রেল রুটে এতো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ মার্চ ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় জয়ন্তিকা ট্রেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা রেলসেতুর দক্ষিণে রেললাইনের এক ফুট ভেঙে গিয়েছিল। স্থানীয় এক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি মাইজগাঁও রেলস্টেশনে জানান। পরে ওই রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই সময় জয়ন্তিকা ট্রেনও যাত্রাপথে ছিল।

গত ৫ এপ্রিল সিলেট-মাইজভাগ রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী মোগলাবাজার এলাকায় কুশিয়ারা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একইদিন রাতে মাইজগাঁও স্টেশন এলাকায় শাহজালাল সার কারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রেনেটর বগি লাইনচ্যুত হয়।

গত ১৬ মে কুশিয়ারা সেতু পার হয়ে মল্লিকপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় একটি ট্রেন। পরে ২ জুন হবিগঞ্জের বাহুবল এলাকায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ১৬ ঘণ্টা সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল।

২৩ জুন রাতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে উপবন এক্সপ্রেস। সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনের আগে মনছড়া রেলসেতুতে ট্রেনটির ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগে পড়ে যায় সেতুর নিচে, দুটি উল্টে পড়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় চারজনের, আহত হন শতাধিক মানুষ। দুর্ঘটনার ২১ ঘণ্টা পর সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছিল।

২৮ জুন সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস বড়ছড়া রেলসেতুর আগে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আটকা পড়ে। পরে প্রকৌশলীরা এসে সেতুটি তাৎক্ষণিক সংস্কার শেষে ট্রেন চলে।

গত ৭ জুলাই ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কুলাউড়ার হাজীপুর এলাকায় একটি গরুকে ধাক্কা দেয়। গরুটি মারা যায়, রেলের ইঞ্জিনের সামনের হুইস পাইপ ভেঙে যায়। এতে বিকল হয়ে পড়েছিল ইঞ্জিন।

গত ১৯ জুলাই সিলেট থেকে ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কুলাউড়া জংশন রেলস্টেশনে প্রবেশের সময় এটির বগি লাইনচ্যুত হয়। পরদিন (২০ জুলাই) সকালে একই স্থানে লাইনচ্যুত হয় ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেন। আগের দিন দুর্ঘটনার পর রেলের স্লিপারের ক্লিপ উঠে যায়। পরে এগুলো সংস্কার না করায় একইস্থানে দুর্ঘটনা ঘটে বলে তখন জানা গিয়েছিল।

এদিকে, গত ১৬ আগস্ট রাতে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকায় ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়। আতঙ্কে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আহত হন ১০-১৫ জন যাত্রী।

৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয় ফেঞ্চুগঞ্জের মল্লিকপুরে। ১৭ সেপ্টেম্বর একই ট্রেন মাইজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। এছাড়া গেল ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় লাইনচ্যুত হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে রেলপথের দিকে সরকারের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। শুধু সিলেট রুটেই নয়, সারাদেশে রেলপথের সংস্কার সাধন জরুরি। একইসঙ্গে রেলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে।

জানা গেছে, রেল সেবার মানোন্নয়নে রেল মন্ত্রণালয়ে চারটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চিঠি পাঠিয়েছে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। গত ১৩ অক্টোবর এই চিঠি পাঠানো হয়।

চিঠিতে সিলেট-ঢাকা রুটে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ট্রেনের এসি কোচ সংযোজন, সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেনে এসি কোচ সংযোজন, সিলেট-আখাউড়া ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার এবং ট্রেনের মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও জরাজীর্ণ বগি পরিবর্তন করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

সিলেট চেম্বারের সভাপতি এ টি এম শোয়েব বলেন, ‘রেল মন্ত্রণালয়ে আমাদের চিঠি প্রেরণের পর এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সিলেট-১ আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ বিষয়ে আন্তরিক। তিনি বিষয়টি দেখছেন। শিগগিরই ইতিবাচক কিছু আসতে পারে।’ সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন