অপরাধ ও দুর্নীতি ১২ নভেম্বর, ২০২২ ১১:১৪

বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যা: রহস্যের জট বাড়ছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যায় রহস্যের জট যেন বাড়ছেই। ফারদিনের খুন হওয়ার পর যেসব কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসছে, তার অনেক কিছুই নিজেদের দেখার সঙ্গে মেলাতে পারছেন না তার বন্ধু আর স্বজনরা।

একাধিক সহপাঠী বলেছেন, ফারদিনকে তারা চিনতেন পড়ালেখা, বিতর্ক আর টিউশনিতে ব্যস্ত নম্র স্বভাবের এক ছেলে হিসেবে। কারও সাথে তার প্রেম আছে, তেমন কিছুও আগে জানা ছিল না।

একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মাদক কিনতে গিয়ে মাদক কারবারিদের পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ফারদিনের। অথচ কখনও তাকে মাদকাসক্ত বলে মনে হয়নি বলে তার এক বন্ধুর ভাষ্য।

তাদের দেখা ফারদিন চিন্তা-চেতনায় যুক্তিবাদী তরুণ ছিলেন, উগ্রবাদে তার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেটা তাদের বিশ্বাস হয় না।

ডেমরার যে এলাকায় ফারদিনদের বাসা, একই এলাকায় থাকতেন রুয়েটে লেখাপড়া করা সাজ্জাদ হোসাইন, বয়সে ফারদিনের দুই বছরের বড় হলেও খেলাধুলা করতে গিয়ে তখন থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।

ফারদিনের মৃত্যুর পর সংবাদ মাধ্যমে আসা বিভিন্ন খবর দেখে বিরক্ত সাজ্জাদ ফেইসবুকে লিখেছেন, পরশ ছিল নিরহংকারী। ওর মতো একজনের সামান্য হলেও অহংকার থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার কোনো অহংকার ছিল না। আপনি নো-বডি হলেও আপনি যদি তাকে এক বর্ণ শেখানোর সক্ষমতা রাখেন, পরশকে আপনি শিষ্য হিসাবে পাবেন। মনোযোগী শ্রোতা ছিলো সে, কিন্তু বলবে সামান্য।

পারিবারিক সংস্কৃতির কারণেই হয়ত, পরশ ছিল অত্যন্ত নম্র একজন মানুষ। পরশকে তার ছোটো ভাইদের সাথে দু-একবার চিৎকার করতে দেখেছি সেই ছোটো বয়সে। এছাড়া কখনো কোনো উচ্চবাচ্যের রেকর্ড তার নাই।পরশের কোনো অ্যাকটিভিজম নাই, তার কাজ ছিল শুধু ডিবেট, টিউশনি, পড়াশুনা, ল্যাপটপের দু-একটি গেম খাওয়াদাওয়া। নারী-সংশ্লিষ্ট কিছুও নাই আমার জানা মতে।

ফারদিনকে বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হিসেবে বর্ণনা করে সাজ্জাদ লিখেছেন, এমন একজন মানুষকে নিয়ে আবার কিছু নিউজ করছে ফান্ডামেন্টালিস্ট সন্দেহ করে। আর যেহেতু সে কোনো অ্যাকটিভিজম করত না, তাই তার উল্টোটাও সত্যি হওয়ার চান্স কম।

ফারদিন ছিলেন বুয়েটের পুরকৌশল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু বলেছেন, ফারদিন সিগারেটের ধোঁয়াতেও বিরক্ত প্রকাশ করতেন তার বিশ্বাস, ফারদিন মাদক কিনতে রূপগঞ্জে যাওয়ার বিষয়টি বানোয়াট

গত সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ২৪ বছর বয়সী ফারদিনের লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। তার আগে তিন দিন ধরে তার কোনো খাঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক জানান, ওই তরুণকে হত্যা করা হয়েছে।

ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকার রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে আসামি করা হয় ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে।

এজাহারে বলা হয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বুশরার সঙ্গে সেদিন বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ছিলেন ফারদিন। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেরিয়ে তারা রিকশায় করে রামপুরা পর্যন্ত যান।

ওই রাতে আর হলে ফেরেননি ফারদিন। পরদিন পরীক্ষা দিতে না যাওয়ায় বন্ধুরা খোঁজ শুরু করেন। খবর পেয়ে বাবা গিয়ে ডিজি করেন রামপুরা থানায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফারদিনের মোবাইল ফোনের সিগন্যাল পাওয়া গিয়েছিল সর্বশেষ সদরঘাট-কেরানীগঞ্জের দিকে। অথচ তার লাশ পরে পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে।

মামলা হওয়ার পর পুলিশ বুশরাকে গ্রেপ্তার করেছে, আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডেও পেয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে কোনো নতুন তথ্য মিলেছে কি না, পুলিশ সে বিষয়ে কিছু জানায়নি।

ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “পরদিন তার পরীক্ষা, আর সে আগের রাতে মাদক সেবনের জন্য চনপাড়ায় এতদূর যাবে? এটাও বিশ্বাস করতে হবে? শুধু পরদিনের পরীক্ষাই না, সে মাদ্রিদে যাবে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে৷ এমন একটা ছেলেকে নিয়ে এভাবে আলোচনা হচ্ছে, আর কীইবা বলার থাকতে পারে।

তিনি বলেন, আমার ছেলে তো ধূমপানই করে না। আমি ধূমপান করি, ছাড়তে পারি না বলে ছেলেরা অনেক সময় মন খারাপ করে। আমার ছেলে পরশ কখনোই সিগারেট খায়নি, তাকে মাদকসেবী বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন বলেন, বুয়েটের একজন স্টুডেন্ট বনশ্রী থেকে কেরানীগঞ্জ গিয়েছে, সেখান থেকে রূপগঞ্জের চনপাড়া গেছে? এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? সে মাদক পেতে চাইলে তো বুয়েটের ওদিক থেকেই পেতে পারত। এত দূরে যেতে হবে কেন? লজিক্যাল একটা জায়গা থেকে তো চিন্তা করতে হবে৷

আমার ছেলের ৩৭ হাজার টাকায় কেনা মোবাইল ফোন, ব্লুটুথ এয়ারফোন, হাতঘড়ি, মানিব্যাগ ছিল। সবই পাওয়া গেছে। মাদক বিক্রেতাদের সাথে যদি টাকার লেনদেন নিয়েই ঝামেলা হত, তাহলে এগুলো কেন পাওয়া যাবে? মাদক বিক্রেতারা তো এসব রেখে আর্থিকভাবে লাভবান হতেই পারত। কোন যুক্তিতে মাদকের আলোচনাটা আসতেছে এখানে, তাই বুঝতেছি না।

বুকে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছে

কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কাজী নূরউদ্দিন। ছেলের বুকে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এছাড়া আর কোনো আঘাত নেই৷ সাত-আটজন মিলে আমার ছেলেকে মারলে তো সারা শরীরে আঘাত পাওয়া যেত৷ আমার যে ছেলেটা মাদ্রিদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল, সেই ছেলেটার মাথায় আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে৷ ধীরে ধীরে নির্মমভাবে কষ্ট দিয়ে আঘাত করেছে৷

আমার ছেলের মৃত্যু রহস্য এটা এখন জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না৷ আমার ছেলে তার দল মাদ্রিদে বিতর্কে বিজয়ী হয়ে আসবে৷ জানুয়ারিতে দেশে একটা উৎসবও হতে পারত৷ জাতীয় ইস্যু সেটা হতে পারত৷ তা আর হল না৷

ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার দাবি করে তিনি বলেন, আমি তো আমার ছেলেকে আর পাব না৷ কিন্তু চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক, বিচারটা হোক, আসল অপরাধী চিহ্নিত হোক।

 

 

আমাদের কাগজ/টিআর