মুক্তমত ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ০১:৫৪

সেন্ট মার্টিন : একটি দ্বীপের কান্না  আমরা কি শুনছি?

নিজস্ব প্রতিবেদক
মোঃ জাহেদুল আনোয়ার
১৯৯৮ সালের মাঝ গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন আমি প্রথম বার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাই।  তখন ইন্টারনেট ব্যবহার ছিলনা, তাই দ্বীপটির   সম্পর্কে আগাম কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিলোনা।  আমাদের কৈশোরের একটা বিশাল প্রভাব বিস্তারে কারি ছিলেন প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমেদ।  তার লেখনীর দ্বারা সেন্ট মার্টিন এর সাথে প্রথম প্রেম।I
দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
সেই সময় দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল নয়নাভিরাম। সুনীল জলরাশির উপর সাদা তুলার মতো উড়ে যাওয়া মেঘের ছায়া এক হৃদয়স্পর্শী দৃশের মায়াজাল তৈরি করতো।  পূর্ণিমা রাতে আলোয় বিদ্যুৎ বিহীন দ্বীপটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এক মোহনীয় আবেদন তৈরি করতো 
জোয়ারের পর উপকূলে হাজার হাজার নানা বর্ণের বিচিত্রময় সামুদ্রিক শামুক ঝিনুক পরে থাকতো।  
দুর্লভ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের অভয়ারণ্য ছিল দ্বীপটি।  প্রকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা কেয়া বনের সবুজ বেষ্টনী দ্বীপটির সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিত অনেক গুণ।  সুনীল জলরাশির উপর হাজার বছরের প্রাচীন প্রবালের ফাঁকে ছোট মাছের জলকেলী আপনার সারা জীবনের সুখ স্মৃতি হয়ে থাকবে।    
দ্বীপের রঙিন প্রবাল থেকে শুরু করে  সামুদ্রিক কচ্ছপ, অ্যাঞ্জেলফিশ, তারা মাছ , নানা রঙের ঝিনুক  এবং আরও অনেক কিছুর এক ঝলক দেখতে পেতেন। দ্বীপের সমুদ্রের নীচের জীবন সত্যিই আপনার  অনেক ভালো লাগতো
দ্বীপটি সুন্দর প্রবাল প্রাচীরের উপরে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে, প্রবালদের রেখে যাওয়া চুনাপাথরের কঙ্কাল দ্বারা গঠিত দ্বীপটি। পুরানো এবং মৃত প্রবাল নতুন প্রবালের বৃদ্ধি এবং প্রাচীর প্রসারিত করার জন্য একটি বৃদ্ধির মাধ্যম প্রদান করে।যদিও ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পাথর-বালু, প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণসহ সব ধরনের স্থাপনা-অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়। গত দুই দশকে সরকারি আইন অমান্য করে দ্বীপের যত্রতত্র তৈরি হয়েছে ২৩০টির বেশি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ। এগুলোর কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
দ্বীপের সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা ১৪ দফায় বলা আছে, রাতের বেলায় সৈকতে কোনো প্রকার আলোকসজ্জা বা আগুন জ্বালানো, আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ। জোয়ার–ভাটা এলাকার পাথরের ওপর হাঁটাচলা নিষেধ। দ্বীপের সৈকতে মোটরসাইকেলের মতো যান্ত্রিক বাহন থেকে শুরু করে সাইকেল, ভ্যান, রিকশার মতো অযান্ত্রিক বাহনের চলাচল নিষিদ্ধ। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরা, সৈকতে রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করে ছবি তোলা, সৈকতে মাইক বাজানো, হইচই বা উচ্চ স্বরে গানবাজনা, বারবিকিউ পার্টি করা নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। 
মানুষের নিষ্ঠুরতায় প্রবাল দ্বীপটির কান্না ক্রমান্বয়ে বাড়ছে 
কোটি টাকার ব্যবসা হলেও জীববৈচিত্র্য-প্রতিবেশের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)।   যেমনটি আগে বলেছি ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালার ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রচলিত বিধিমালা, প্রবিধান মালা, পরিপত্র বা আইনগত দলিলে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাভুক্ত কোনো ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের সম্মতি নিতে হবে।
সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক ও কড়ি, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিমের ডিম পাড়ার স্থান এই দ্বীপের বালিয়াড়ি। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের গমন ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ১১টি জাহাজে দিনে প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যান। দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য ফেলা হয়। বড় উদ্বেগের দিক হলো, দ্বীপে কেয়াবন উজাড় করে হোটেল-রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছে। 
২০২০ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কাউসার আহাম্মদ, ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মো. ইউসুফ গাজী ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাহরিমা জান্নাতের এক গবেষণায় উঠে আসে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে তিন বর্গকিলোমিটারে।
পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে ইসিএ ঘোষণা করে। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এরপর জনপ্রিয় হলিউড তারকা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এর জন্য বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বেসরকারি সংস্থাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় যে খসড়া নির্দেশিকা তৈরি করেছে, তা নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি ওই দিন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষে নিয়মিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গিয়ে অবৈধ স্থাপনা ও অন্যান্য অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব নয়। তাঁর প্রস্তাব পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থায়ী জনবল ও কার্যালয় সেখানে থাকতে হবে। যাতে তাঁরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন যখন একে অপরকে দায়দায়িত্ব নিতে বলছে, তখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বেড়েই চলছে। পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, নির্জন সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়াবন উজাড় করে অবকাঠামো তৈরি, গভীর রাত পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় আলোকসজ্জা, লোকজনের হইচই এবং জেনারেটরের বিকট শব্দে ডিম পাড়তে আসতে পারছে না মা কচ্ছপ। 
সৈকতের বালুচর দিয়ে পর্যটকবাহী ইজিবাইক (টমটম) ও মোটরসাইকেল চলাচল করে। ফলে শামুক, ঝিনুক, লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

ভ্রমণনিষিদ্ধ এলাকায়ও রিসোর্ট
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গলাচিপা থেকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। কারণ, সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়তে যায়। এই নিষিদ্ধ এলাকায়ও ৩০টির বেশি দোতলা রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গোধূলি, দীপান্বিতা, দ্বীপান্তর, জ্যোৎস্নালয়, সিংসুক, সায়েরী, স্যান্ডক্যাসল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সূর্যবান, বেলা ভিসতা, সানসেট, সেরেনিটি, সিন্দাবাদ উল্লেখযোগ্য।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের হোটেল-রিসোর্টে রোহিঙ্গা তরুণ ও শিশু-কিশোরেরা কাজ করে। তারাই ব্যাটারিচালিত বেশির ভাগ ইজিবাইক চালায়। অভিযোগ আছে, মালিকেরা তাদেরও কাজে নেন কম মজুরি দেওয়া যায় বলে। এটা অবৈধ ও এ নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষোভ রয়েছে।
স্থানীয়দের বাস ঝুপড়িতে
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো ইটের ভাটা নেই। রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী আসে ট্রলারে ৩৪ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ সদর থেকে। নির্মাণসামগ্রী দ্বীপে নিতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের পূর্বানুমতি লাগে। কিন্তু নিয়মকানুন বাধা হতে পারেনি হোটেল-রিসোর্ট নির্মাতাদের সামনে। কিন্তু দ্বীপের সাধারণ মানুষ পাকা ঘর করতে পারেন না। তাঁদের বেলায় ঠিকই বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসন।
‘তাঁরা অবৈধ সুবিধাভোগী’
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট মার্টিন রক্ষায় আইন আছে, বিধিবিধান আছে, নির্দেশনা জারি করা আছে, প্রশাসন আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর আছে, পুলিশ আছে, কিন্তু সবার সামনে দ্বীপটি ধ্বংস হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় কর্মকর্তারা বেতন পান, তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝেমধ্যে অভিযান হয়, অল্প কিছু টাকা জরিমানা হয়, কিন্তু দোতলা, তিনতলা ভবন নির্মাণ বন্ধ হয় না।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যে অবৈধ হোটেল-রিসোর্ট আছে, গড়ে উঠছে, এটা প্রশাসনের কারও অজানা নয়। তারা এগুলো হতে দেয়, কারণ এর অবৈধ সুবিধাভোগী তারা। মাঝেমধ্যে যে অভিযান চলে, সেগুলো মূলত লোকদেখানো।  সেন্ট মার্টিনকে রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। সেটা দেখা যাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরে সেন্টমার্টিন দ্বীপ, যা বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল-বহনকারী দ্বীপ, অতিরিক্ত পর্যটন কার্যক্রমের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। সীমাহীন এবং পরিবেশগতভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যটন কার্যক্রমের কারণে এই দ্বীপ হুমকির মুখে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভঙ্গুর ইকোসিস্টেম শুধুমাত্র টেকসই পর্যটনের জন্য উপযুক্ত। 

প্রতিবেদক : জাহেদুল আনোয়ার